শীতে অতিরিক্ত চা-কফি মানেই বিপদ, সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা
শীত এলেই অনেকেই গরম গরম চা বা কফির কাপে হাত বাড়ান। ঠান্ডায় শরীরকে উষ্ণ রাখার সহজ উপায় যেন এই পানীয়গুলোই। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, শীতকালে অতিরিক্ত চা–কফি পান করলে হঠাৎ করে হাঁটু বা শরীরের অন্য জয়েন্টে ব্যথা ও শক্তভাব বাড়তে পারে। বিষয়টি একটু অদ্ভুত শোনালেও এর পেছনে রয়েছে শরীরের স্বাভাবিক জৈব কারণ, যা শীতের আবহাওয়া এবং ক্যাফেইনের যৌথ প্রভাবে আরও জটিল হয়ে ওঠে। তাই শীতকালে জয়েন্ট ব্যথা কেন বাড়ে, কেন চা–কফি এর প্রভাবকে আরও তীব্র করে তোলে এবং কীভাবে এই সমস্যা এড়ানো যায়—তা বুঝে নেওয়া জরুরি।
এ ধরনের সমস্যার ব্যাপারে ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম দেশটির রায়পুরের অর্থোপেডিক ও স্পোর্টস ইনজুরি বিশেষজ্ঞ ডা. দুষ্মন্ত চৌহানের পরামর্শ তুলে ধরেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ডা. চৌহান জানিয়েছেন, চা-কফি গরম হলেও এসব জয়েন্ট বা হাড়কে শুষ্ক করে দিতে পারে। তার ভাষ্য, হাঁটুর যে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি, এটি এমন স্থর, যা দুই হাড়ের মাঝখানে কুশনের মতো কাজ করে থাকে। এই কর্টিলেজের বড় অংশই হচ্ছে পানি দিয়ে তৈরি। সেখানে এই পানি না থাকলে এর ইলাস্টিনিটি ও শক-অ্যাবজরব করার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পায়।
শীতকালে আমাদের অনেকের মধ্যেই অজান্তে ডিহাইড্রেশন তৈরি হয়, কারণ ঠান্ডার সময় তৃষ্ণা বেশি অনুভূত হয় না। ফলে আমরা পানি কম খাই এবং তার জায়গায় বারবার চা বা কফি পান করি। অথচ চা–কফি কখনই শরীরের প্রয়োজনীয় তরলের বিকল্প নয়, বরং এর অতিরিক্ত সেবন শরীর থেকে আরও পানি বের করে দিতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, শীতকালে রক্তনালিগুলো স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত হয়, যার ফলে রক্তসঞ্চালন ধীর হয়ে যায়। এই অবস্থায় শরীরের জয়েন্ট টিস্যুতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে দেরি হয়। তার সঙ্গে যোগ হয় অতিরিক্ত ক্যাফেইনের প্রভাব। ক্যাফেইন হালকা ডাইইউরেটিক হওয়ায় প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ায় এবং শরীরে জলীয় অংশের ঘাটতি তৈরি করে। ফলে হাঁটুর ভিতরের কার্টিলেজ ধীরে ধীরে তার আদ্রতা হারাতে থাকে।
ডা. চৌহানের ভাষ্যমতে, কার্টিলেজ শুকিয়ে যাওয়ার কারণে হাড়ের ওপর হাড়ের ঘর্ষণ বাড়ে, যার ফলে হাঁটু শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা বাড়ে এবং হাঁটাচলায় অস্বস্তি তৈরি হয়। শীতের সকালে বা দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে হাঁটুতে যেই টান অনুভূত হয়, সেটাও এই ডিহাইড্রেশনজনিত কার্টিলেজ সমস্যার কারণেই হয়ে থাকে বলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।
এদিকে অর্থোপেডিক ট্রমা ও জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জন ডা. পি সি জগদীশ জানিয়েছেন, ক্যাফেইন সরাসরি কার্টিলেজ নষ্ট করে না, কিন্তু শরীরকে ডিহাইড্রেট করার মাধ্যমে জয়েন্টে সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কার্টিলেজের ভিতরে থাকা জলীয় অংশই একে নমনীয় রাখে। শরীরে পানি কম থাকলে কার্টিলেজ থেকে পানি বেরিয়ে যায় এবং জয়েন্টে প্রয়োজনীয় লুব্রিকেশন কমে যায়। এর ফলে চলাফেরার সময় ফ্রিকশন বা ঘর্ষণ বেড়ে ব্যথা, শক্তভাব এবং প্রদাহ বাড়তে পারে। তাই সমস্যা ক্যাফেইন নয়, বরং শীতকালের দীর্ঘস্থায়ী, কম্পাঙ্কের ডিহাইড্রেশন, যা অজান্তেই অনেক মানুষের মধ্যে তৈরি হয়।
শীতে অনেকেই পানি কম পান করেন। কারণ শীতে তৃষ্ণা কম অনুভূত হয়। কিন্তু শরীরের বিপাকক্রিয়া, রক্তপ্রবাহ এবং জয়েন্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম সবই ঠিক রাখতে পানি অপরিহার্য। চা–কফি সাময়িক উষ্ণতা দেয় ঠিকই, তবে এগুলো শরীরের প্রয়োজনীয় পানিশূন্যতা পূরণ করতে পারে না। এজন্য প্রতি কাপ ক্যাফেইন গ্রহণের পর একগ্লাস পানি পান করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
ডা. জগদীশের মতে, যারা প্রতিদিন তিন–চার কাপের বেশি চা–কফি পান করেন, তাদের দৈনিক কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করা উচিত। তা না হলে জয়েন্ট লুব্রিকেশন কমে গিয়ে আর্থ্রাইটিস বা দীর্ঘস্থায়ী হাঁটু ব্যথার সমস্যা বাড়তে পারে।
এই অবস্থায় শরীরের নড়াচড়া কমে গেলে সমস্যাটি আরও তীব্র হতে পারে। শীতে অনেকেই কম হাঁটাহাঁটি করেন এবং বেশি সময় ঘরে বসে থাকেন। দীর্ঘসময় একই ভঙ্গিতে বসে থাকা বা শরীর ঠান্ডা রাখা হাঁটুর টিস্যু শক্ত করে দেয় এবং ব্যথাকে বাড়িয়ে তোলে। তাই শীতে শুধু পানি পান নয়, সঙ্গে নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, স্ট্রেচিং, হাঁটা, সাইক্লিং বা পানিভিত্তিক লো-ইমপ্যাক্ট এক্সারসাইজ জয়েন্টকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
পুষ্টিবিদদের মতে, শীতে ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম এবং ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। কারণ এগুলো কার্টিলেজকে পুষ্টি দেয় এবং প্রদাহ কমায়। সূর্যের আলো কম পাওয়া শীতের দিনগুলোতে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি হতে পারে, যা আবার হাঁটু বা হাড়ের ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সকালের হালকা রোদে কিছু সময় হাঁটা, গরম পোশাক পরে শরীর গরম রাখা এবং সুষম খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই সব কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চা–কফি একদমই বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে শীতে এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, পানি পান বাড়ানো এবং শরীরকে সচল রাখা—এই তিনটিই জয়েন্ট ব্যথা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে।

ফিচার ডেস্ক