গাজায় আসলে কোনো যুদ্ধবিরতি নেই
গত ১০ অক্টোবর গাজায় যখন ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন অনেক ফিলিস্তিনি স্বস্তি আশা করেছিলেন, কিন্তু সেই স্বস্তি বাস্তবে আসেনি। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এই ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পর থেকে বিরতিহীনভাবে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই অল্প সময়ের মধ্যে গাজায় যে বোমাবর্ষণ হয়েছে, তার বিস্ফোরক শক্তি ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরক শক্তির প্রায় ছয় গুণ বেশি ছিল।
বিধ্বংসী ঘটনাটি সর্বত্র বিদ্যমান। সব হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে, বেশিরভাগ বাড়িঘর ও স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ লাইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো মেরামত করার অযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনুমানিক পাঁচ কোটি টন ধ্বংসস্তূপ পুরো উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এর নীচে বোমাবর্ষণে নিহত কমপক্ষে ১০ হাজার ফিলিস্তিনির মরদেহ এখনো উদ্ধার করা যায়নি।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্যমতে, ৪৪ দিনে ইসরায়েল প্রায় ৫০০ বার ‘যুদ্ধবিরতি’ লঙ্ঘন করেছে, যার ফলে ৩৪২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল ২৯ অক্টোবর, যখন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী (আইওএফ) ১০৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, যার মধ্যে ৫২ জন শিশুও ছিল। সম্প্রতি, গত বৃহস্পতিবার গাজা শহরের জেইতুন পাড়ায় একটি ভবনে বোমা ফেলার সময় একটি পুরো পরিবারসহ ৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।
বোমাবর্ষণ থামেনি, সেইসঙ্গে দুর্ভিক্ষও থামেনি। ‘যুদ্ধবিরতি’ চুক্তি অনুসারে, প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও ইসরায়েল তা পূরণ করছে না।
আল জাজিরার সংবাদদাতা হিন্দ আল-খৌদারি গাজা থেকে জানিয়েছেন, আইওএফ প্রতিদিন মাত্র ১৫০ ট্রাককে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। তারা মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য ও শাকসবজিসহ পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ, তাঁবু ও আশ্রয়ের জন্য অন্যান্য উপকরণের প্রবেশও রোধ করছে। ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংস্থাগুলোর একটি জোট অনুমান করেছে, এখন যে সাহায্য আসছে তা জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদার এক চতুর্থাংশও পূরণ করে না।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিওএ)-এর গুদামে গাজার সবাইকে খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত খাবার থাকা সত্ত্বেও তাদের এখনো কোনো সাহায্য আনতে দেওয়া হচ্ছে না। এটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কর্তৃক অক্টোবরে দেওয়া পরামর্শমূলক মতামতের সরাসরি লঙ্ঘন।
যেখানে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলি সরকারের কর্তব্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাহায্য সরবরাহে বাধা না দেওয়া। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আইসিজে-র রায়ে গাজায় গণহত্যার সম্ভাব্য ঘটনা ঘটছে বলে যে অস্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, ইসরায়েলি সরকার তাও মেনে চলছে না।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৮০৩ নম্বর প্রস্তাব পাস করে, যা গাজার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০-দফা পরিকল্পনাকে সমর্থন করে। এই পরিকল্পনার অধীনে দুটি সংস্থা তৈরি করা হবে— একটি শান্তি বোর্ড (ট্রাম্পের সভাপতিত্বে) এবং ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর নিরাপত্তা বজায় রাখা ও নিরস্ত্রীকরণ কার্যকর করার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী।
প্রস্তাবটিতে গণহত্যার কোনো উল্লেখ নেই ও যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়নি। মূলত, প্রস্তাবটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ দেয়।
এই সমস্ত ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, এই নামেমাত্র ‘যুদ্ধবিরতি’ আসলে কোনো যুদ্ধবিরতি নয়। ইসরায়েলিরা গাজায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখছে এবং তাদের প্রয়োজনীয় আশ্রয় ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করছে। এই ব্যবস্থাটিকে ‘যুদ্ধবিরতি’ বলার মাধ্যমে অন্যান্য দেশগুলো সংঘাত সমাধানের মিথ্যা দাবি করার সুযোগ পাচ্ছে, অথচ বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার ভয়াবহতা একই রকম থেকে যাচ্ছে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক