শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার
হারিয়ে যাওয়া হুইসেল ও ফিরে আসার গল্প
নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগের সম্পর্ক বহু পুরনো। সেই ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তী হলো শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার বা যা সাধারণের কাছে 'রকেট সার্ভিস' নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে জন্ম নেওয়া এই জলযানগুলো কেবল একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, বরং এটি বাংলাদেশের নদীভিত্তিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং এক বিস্মৃত যুগের আভিজাত্যের প্রতীক। দ্রুত আধুনিকায়নের স্রোতে যদিও একসময় এর বাণিজ্যিক যাত্রা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবুও নদীপথের এই চলমান ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে আবারও পর্যটন সার্ভিসে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঐতিহ্যের ইতিহাস: যখন স্টিমার ছিল 'রকেট'
প্যাডেল স্টিমারের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৮৮৪ সালে, ব্রিটিশ শাসনামলে। সেসময় এই কয়লাচালিত বাষ্পীয় ইঞ্জিন (পরে ডিজেলে রূপান্তরিত) চালিত নৌযানগুলো ছিল বাংলার সবচেয়ে দ্রুতগামী জলযান। ঠিক এই কারণেই এর নাম হয়ে যায় 'রকেট'।
একসময় এই স্টিমারগুলো ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচল করত। দেশভাগের পর তা ঢাকা থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীবন্দরগুলো, বিশেষ করে বরিশাল, খুলনা (মোরেলগঞ্জ) এবং তার আশেপাশের রুটে নিয়মিত সার্ভিস দিত।
স্টিমারগুলো ছিল একধরনের ভাসমান প্রাসাদ। এর বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশালকার প্যাডেল হুইল—যা জল কেটে জাহাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কাঠের অভ্যন্তর, দোতলা কাঠামো, প্রশস্ত বারান্দা এবং প্রথাগত আসবাবপত্র সব মিলিয়ে স্টিমারের যাত্রা ছিল আভিজাত্য ও নস্টালজিয়ায় ভরা এক স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা।
কালের সাক্ষী: স্টিমার বহর
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) অধীনে কয়েকটি প্রখ্যাত প্যাডেল স্টিমার ছিল, যাদের প্রত্যেকেই শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই করেছে:
পিএস মাহসুদ: যা সম্প্রতি সংস্কার করে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি সম্ভবত ১৯২৮ সালে নির্মিত।
· পিএস অস্ট্রিচ
· পিএস লেপচা
· পিএস টার্ন
এই স্টিমারগুলো প্রায় ২০-২২ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রায় চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাটসহ ১৩টি নদী ও ২৭টি জেলার উপকূল ছুঁয়ে যেত।
হারিয়ে যাওয়া হুইসেল ও ফিরে আসার গল্প
গত কয়েক বছরে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন এবং পুরনো ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণ জনিত জটিলতার কারণে এই ঐতিহাসিক 'রকেট সার্ভিস' তার বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারায়। অবশেষে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা-মোরেলগঞ্জ রুটে এই সেবার বাণিজ্যিক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, হয়তো নদীর বুকে আর কোনোদিন শোনা যাবে না সেই চেনা হুইসেলের শব্দ।
তবে, আশার কথা হলো বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও নদীভিত্তিক পর্যটনের সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করতে আবারও এই স্টিমারগুলো ফিরছে।
নতুন রূপে 'পিএস মাহসুদ': পর্যটনের ঐতিহ্য
সম্প্রতি, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার, বিশেষত পিএস মাহসুদকে, আধুনিক সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সজ্জিত করে পুনরায় চালু করার।
পর্যটন সার্ভিস: এটি আর নিয়মিত যাত্রী পরিবহন নয়, বরং একটি নিয়মিত পর্যটন সার্ভিস হিসেবে চলাচল করবে। এর লক্ষ্য হলো নতুন প্রজন্ম ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে নদীপথের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের নদীভিত্তিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরা।
আকর্ষণ: আধুনিক কেবিন, পর্যটক-বান্ধব ডেক এবং ডিজিটাল নেভিগেশন ব্যবস্থা যুক্ত হলেও স্টিমারের ঐতিহাসিক কাঠামো ও নস্টালজিক আবেদন অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার কেবল একটি জলযান নয়; এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। নদীর সৌন্দর্য, ইতিহাসের গল্প আর এক আভিজাত্যপূর্ণ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা—সবকিছু একসঙ্গে নিয়ে এই 'রকেট' সার্ভিস আবারও বাঙালির নস্টালজিয়ায় ভেসে ওঠার অপেক্ষায়।

ফিচার ডেস্ক