১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান: এক স্বৈরশাসকের পতনের আখ্যান
আজ ৬ ডিসেম্বর, স্বৈরাচার পতন দিবস। এই দিনে ১৯৯০ সালে দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় সূচিত হয়েছিল। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ (এইচ এম) এরশাদ। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, যা জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে স্বৈরাচারের অনিবার্য আত্মসমর্পণের প্রতীক।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ সামরিক আইন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন, যা গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে সূচনা করে এক দীর্ঘ স্বৈরশাসনের। এই শাসনকাল ছিল জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের এক অন্ধকার অধ্যায়। তবে, শুরু থেকেই এই অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এবং বামপন্থী দলগুলো একটানা আন্দোলন চালিয়ে যায়।
দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনে বারবার আন্দোলন দমনের চেষ্টা হলেও, বিরোধী দলগুলো তাদের সংগ্রাম থামায়নি। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে সম্মিলিত বিরোধী জোট নতুন করে যে আন্দোলন শুরু করে, তা দ্রুতই গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয়। এই আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই বাড়তে থাকে যে, এরশাদের সরকারের অবস্থান যা একসময় 'সুরক্ষিত' মনে হয়েছিল (যেমনটি মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মনজুর রশীদ খান তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন), তা দ্রুতই নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন : শহীদ নূর হোসেন দিবস: গণতন্ত্রের জন্য এক রক্তক্ষয়ী শপথ
আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে, প্রধান তিনটি রাজনৈতিক জোট—আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট, এবং ওয়ার্কার্স পার্টি-জাসদ নেতৃত্বাধীন জোট—এক ঐতিহাসিক ঐক্যের নজির স্থাপন করে। তারা ১৯৯০ সালের ২১ নভেম্বর যৌথভাবে একটি রূপরেখা ঘোষণা করে, যা স্বৈরশাসকের পতনের পথকে অপরিহার্য করে তোলে। কোনো জোটে না থেকেও এই আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীরও অংশগ্রহণ ছিল। এই সম্মিলিত রাজনৈতিক চাপ এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
এই দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অসংখ্য দেশপ্রেমিক মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য প্রাণ দেওয়া এই শহীদদের মধ্যে নূর হোসেন, ডা. মিলন, সেলিম, দেলোয়ার, তাজুলসহ আরও অনেকে রয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগই নিশ্চিত করেছিল আজকের এই দিনের আগমন, যখন আমরা স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার উদযাপন করি। তাঁদের নির্ভীকতা ও আত্মদানের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও মজবুত হয়েছে।
মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মনজুর রশীদ খান, যিনি এরশাদের সামরিক সচিব হিসেবে (১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর থেকে) এবং পরবর্তীকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনেও দায়িত্ব পালন করেন, তাঁর ‘এরশাদের পতন ও সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী শাসন কাছ থেকে দেখা’ বইয়ে এই সময়ের নানা ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। তার লেখায় উঠে আসে যে, এমনকি ১৯৯০ সালেও অনেকে মনে করত এরশাদের সরকারের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট ভালো ছিল। এরশাদ নিজে ১৯৮৭ সালের নভেম্বরের আন্দোলন দমনের কৌশল নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু, জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সব আত্মবিশ্বাস ও কৌশল ব্যর্থ হয়, যা প্রমাণ করে জনমতের বিরুদ্ধে কোনো স্বৈরশাসনই টিকে থাকতে পারে না।
৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস কেবল একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন নয়, এটি বাংলাদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও বিজয়ের দিন। এই দিনটি প্রতি বছর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই যেকোনো স্বৈরশাসনকে পরাভূত করার ক্ষমতা রাখে। আজকের দিনে রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য এই সংগ্রাম আমাদের জাতীয় চেতনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক