ফাগুনের দিনগুলো
স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ারে
১ ফাল্গুন, অর্থাৎ ঋতুরাজ বসন্তের সূচনায় প্রকৃতি বাসন্তী সাজে মনোলোভা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি এখন নতুন সাজে প্রেমোন্মুখ, মানবমনে ফাগুন এসে রঙিন রং ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফাগুনে পুরাতন পৃথিবী হয়ে ওঠে শ্যামল-বরণী, যেন যৌবন-প্রবাহ ছুটে চলে দিগ্বিদিক। কখনো কখনো পুরোনো স্মৃতি বিরহ নিয়ে আসে, আবার নতুন মিলনের হাতছানি থাকে। আসলে নতুন বসন্ত আসে নতুন জীবনের বারতা নিয়ে। এ জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে/কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে/লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরণ-ছটাতে।’
বসন্তের সঙ্গে মিলন যেমন একীভূত তেমনি বিরহ ব্যঞ্জিত হয় কবির কবিতায়। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি/তবুও ফুটেছে জবা, দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে,/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।’ এই যে মৃত্তিকার বুকে আনন্দ-জাগানিয়া শিহরণ, দুপুরের ঘূর্ণি পাতার গুঞ্জরণ, চঞ্চল হৃদয়ের সঙ্গীত লহরি সবই এই ঋতুরাজ নিংড়ে নেয় মানব জীবন থেকে। এই আগ্রাসী ঋতুর কবল থেকে আমরা রক্ষা পাই না কেউ-ই। এ সময় গাছে গাছে কচি পাতা ও ফুলের সৌরভ, শিমুল ডগায় নেচে চলা কোকিলের কুহুতান আর প্রেমিকযুগলদের একে-অপরের প্রতি মুগ্ধতা সবই বসন্ত বন্দনায় লীন হয়ে যায়। অবশ্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কাছে বসন্ত বিদ্রোহের প্রতিমূর্তি, প্রেরণাদাত্রী। তাঁর ভাষায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন...।’
১ ফাল্গুন ‘বসন্ত উৎসব’ নামকরণের পেছনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা আছে। তাঁর সংগীত, নাটক ও কবিতায় এই ঋতুর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে অবারিত উৎসুকে। শান্তিনিকেতনে তিনি বসন্ত উৎসব শুরু করেন ফাগুনের প্রথম দিনে। তবে দোল উৎসব হিসেবে দিনটিকে আখ্যা দেননি তিনি। ঋতু উৎসবের সার্বজনীনতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার জন্য কবি এটির নামকরণ করেন ‘বসন্ত উৎসব’। বর্তমানে পয়লা ফাগুন শান্তিনিকেতনের অন্যতম উৎসবে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় উদযাপিত ‘বসন্ত উৎসব’ আমাদের আঙিনার অন্যতম অনুষ্ঠান নতুন রং নিয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। একইভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়লা ফাগুনের বৈচিত্র্য শিক্ষার্থীদের আনন্দযাত্রায় পরিণত হয়েছে। সেই স্মৃতিই এখানে বর্ণনা করছি আমি।
২.
দেখতে দেখতে শীতের আবহ পাল্টে গেল। কী অদ্ভুত সৌন্দর্যে ক্যাম্পাসের চারপাশ জেগে উঠল। ফাগুনের মোহনায় মনমাতানো মহুয়া ফুলের গন্ধ ঢেউ খেলে আমাকে মোহিত করল। রঙিন পাখিদের আলাপন আর সুখ মেখে থাকা ঠোঁটে পাতার সৌন্দর্য আমাকে টেনে নিয়ে গেল অজানা প্রান্তরে। আমার প্রিয় জারুলতলা, কাটা পাহাড়ের নির্জন পথ আর পাহাড়ে হেলান দিয়ে থাকা বৌদ্ধবিহারের পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ কিংবা আইন অনুষদের সোনালুর ফুলঝুরি—প্রকৃতির এই ঐশ্বর্য ফাগুনের স্বতন্ত্র রূপ নিয়ে আমাকে আলোড়িত করে। কাটা পাহাড়ের গায়ে লুকিয়ে থাকা আবাবিল পাখির কলতানের কথা মনে পড়ে। এই ক্যাম্পাসে আমি ছিলাম দীর্ঘদিন। প্রকৃতি যেমন পাল্টে যায় জীবনও তেমনি বদলে যায়। আজকের পয়লা ফাগুনের আনন্দ, উৎসাহ, উদ্দীপনা ক্যাম্পাস জীবন থেকে ভিন্ন। সেই জীবনটা ছিল স্বপ্নময়, আলোড়িত, কচিপাতার মায়ায় জড়ানো। হয়ত তখন আমার চিন্তার জগৎ ততটা প্রসারিত হয়নি। সবকিছুই দেখছি সহজ চোখে, মধুর হয়ে উঠছে যা দেখছি; যা ভাবছি তাই করছি। নিজের অনুভূতি অন্যের কাছে শেয়ার করে খুশি হচ্ছি। ক্যাম্পাসের জীবন স্মৃতিময়, সুখের কলাপাতা যেন, যার কোনায় লেগে থাকে স্বচ্ছ জলের ধারা।
ফাগুনের সকাল ছিল উত্তেজনার, বিপুল উদ্যমের। ঘুম ভাঙতেই শুভেচ্ছা জানানো শুরু হতো। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করে হলের বাইরে চলে আসা। বের হওয়ার আগেই সতীর্থদের সাজসজ্জা দেখে প্রাণের আবেগ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। এক একজনের শাড়ি দেখে আমি নিজেই মোহিত হতাম। ফাগুনের রং কত সুন্দর হয়ে মেখে থাকত সকলের চোখে-মুখে। হলুদের বৈচিত্র্য সত্যিই দেখার মতো ছিল। কেউ কেউ আবার গামছা দিয়ে নিজেকে গ্রামীণ জীবনের মোড়কে তুলে ধরত। আমরা যারা আদিবাসী ছিলাম, তারা নিজেদের পোশাককে ফাগুনের সঙ্গে মিলিয়ে পরতাম। কখনো থামি আর নিজস্ব তাঁতে বোনা বাহারি আচ্ছাদনে সাজাতাম। দুরন্তপনা সেদিন ভেতরে ভেতরে তাড়িয়ে নিয়ে যেত আমাকে। হয়ত হলের বাইরে এসে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, হয়তো কলাভবনের শেষ দিকের গলি দিয়ে ঝর্ণা দেখতে ছুটে চলেছি। কিংবা লাইব্রেরির সামনে রক্তকরবী গাছের লালফুলের দিকে তাকিয়ে আছি। অথবা ছুটে উঠতে চাইছি উপাচার্য ভবনের বাংলোর ঢাল পথ ধরে। এভাবে মেতে উঠতাম সেদিনের বসন্ত দিনে।
৩.
ক্যাম্পাসে সেদিন যখন দখিন দুয়ার খুলে গেছে তখন নিজেকে বাতাবিলেবুর ঘ্রাণে আর আমের মুকুলের গন্ধে ছড়িয়ে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে উন্মনা হয়েছি। বন্ধু আসবে বলেও যখন আসে না তখন নতুন প্রকৃতির পুষ্পসাজ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। মনের আকাশে ফাগুনের আগুন জ্বলে; পিয়াসী পাখি উড়ে চলে সুদূরে। নিজের পাখনায় ভর করে ছুটে চলতে ইচ্ছে জাগে। কারণ আমি তো হৃদয়ের ডাক শুনতে পাই এই ফাগুনে। ‘ফাগুনে আমার ফিরেছে আবার হিমেল বায়, আলোর পেছনে লুকানো ছায়ায় মায়া জড়ায়। কবে চলে গেছ সে কথা কবে ভুলেছি, ভুল করে কেবল সুখের মালা গেঁথেছি।’
এই গানের মর্মভেদী সুর বিরহের যন্ত্রণা নিয়ে আসে সংগোপনে। তবু আমি বসন্তে দেখি বনভূমি ফুলবনে সাজে, চরণে তার পায়েল রমুঝুমু বাজে। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় আত্মহারা হই। বনবীথিতে কোকিলের কলগীতি, আর বকুলের গন্ধে উজ্জীবিত থাকি। ক্যাম্পাসের বসন্ত রাতগুলো ছিল অসাধারণ। রাতের ক্যাম্পাসে কখনো কখনো চাঁদের আলোতে, কখনো বসন্তসমীরণে সেই ত্রিভুবনজয়ী, অপার রহস্যময়ী আনন্দ-মুরতি জেগে উঠত মনে। রবীন্দ্রনাথের কথাই সত্য বলে মানি। তিনি লিখেছেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা, বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।’
আসলে ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল, চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়, বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়, স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে আর পূর্ণিমারাত্রির মত্ততা নিয়ে আমি এখনো সেই স্মৃতির পরশে জেগে থাকি। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে আমরা হারিয়ে যেতে চাই, জীবনকে প্রকৃতির রং, রূপ ও গন্ধে মাতিয়ে নিতে চাই। বসন্তের রঙে পৃথিবীকে ভালোবাসতে চাই, সুন্দর পৃথিবী দেখতে চাই। এ জন্যই সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’
লেখক : সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সিলেট।

জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা