পঞ্চগড়ে কাঞ্চন দর্শন ও নিষ্প্রভ স্থানীয় পর্যটন
ঘুম শিকেয় তুলে উঠে পড়া। তারপর যাত্রা। ছুটে পৌঁছে যেতে হবে তেঁতুলিয়া। রোদ ওঠার আগেই কাঞ্চন তথা কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন। এ রকম একটা ঘটনা স্বপ্ন হলেও সত্যি। বলছেন প্রীতি ওয়ারেসা, পঞ্চগড় শহর থেকে যিনি এত দূর গিয়েছেন এবং সেই কাঞ্চনের ছবি ও ভিডিও তুলেছেন। তাঁর ভাষায়, এটি স্বপ্ন ছিল, কিন্তু সেটি সত্যিও ছিল। করোনায় বিপর্যস্ত জীবনে মানুষের সামনে সুন্দরের ঝাঁপি খুলে দিল পঞ্চগড়ের প্রকৃতি। দেখা মিলল কাঞ্চনজঙ্ঘার।
নীল আকাশের ক্যানভাসে হিমালয়ের শিখর দর্শনে আপ্লুত পঞ্চগড়ের মানুষ। তা নিয়ে বড় বড় গল্প এখানে। সারা দেশ থেকে প্রচুর মানুষ ভিড় জমান এই নিরুত্তাপ শহরে। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মুঠোফোন ও ক্যামেরাবন্দি করেন পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
সম্প্রতি গিয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা এই পঞ্চগড়ে। গিয়েই শুনলাম এখান থেকে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়–এমন এক প্রচারণায় বহু মানুষ ভিড় করছে সেখানে। আমরা দেখতে পাইনি, কারণ এখন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
কখন দেখা যায় আর কখন দেখা যায় না এই বরফঢাকা পর্বতের চূড়া, সে এক বড় প্রশ্ন। করোনায় দূষণ কমেছে, তাই আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা মিলছে কাঞ্চনচূড়ার। এখানেই আসল তথ্য। কখন দেখা যায় আর কখন যায় না–এমন তথ্য পরিষ্কার নয় মানুষের কাছে। ফলে পুরো বিষয়টি ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে পঞ্চগড় শহরে ছুটছে মানুষ।
এখানেই রয়েছে প্রকৃত প্রশ্ন। দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ করে প্রায় এক কোটি মানুষ। সবই অভ্যন্তরীণ পর্যটক। তাদের কাছে পর্যটন স্পট বলতে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজার, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার কুয়াকাটা, প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনস, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ আর সিলেটের চা বাগান। প্রচারণা ছাড়াই কিছু সচেতন পর্যটক খোঁজেন পুরাকীর্তিসহ কিছু বৈচিত্র্যপূর্ণ পর্যটন। চা বাগান এখন পঞ্চগড়েরও বিশেষত্ব।
হাওরের জীবন আর সৌন্দর্য, নদী আর পাহাড় কিংবা এ দেশের সহজ-সরল-সাধারণ গ্রামীণ মানুষের হাসি কোনো পর্যটন-পণ্য নয় আমাদের পর্যটন আমলাদের কাছে।
বাংলাদেশে কম বিদেশি পর্যটক আসে। কেন কম আসে, তার কোনো জবাবদিহিতাও নেই এসব আমলার পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা বিদেশি নাগরিকদের সবচেয়ে বড় অংশই আসে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে, যা মোট বিদেশির ৪০ শতাংশ। এর পরই রয়েছে উন্নয়ন খাতের বিভিন্ন কাজে আসা বিদেশিরা। মোট বিদেশির মধ্যে এদের হার ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন দূতাবাস-সংশ্লিষ্টরা রয়েছে ১৫ শতাংশ করে।
ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কমপিটিটিভনেস রিপোর্টে নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। কক্সবাজার বলেন বা কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবন, যেকোনো স্পটে যাতায়াত মানেই বিভীষিকা। এর পরও এসব স্পটে সারা দেশ থেকে পর্যটক আসে। অথচ সেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তায় ঘাটতি রয়েছে। কক্সবাজার ছাড়া আর কোথাও তেমন থাকার সুবন্দোবস্ত নেই।
আমাদের পর্যটন স্পটগুলোতে বিনোদন নেই। পর্যটকের স্বাদ-আহ্লাদ মেটানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বিদেশি পর্যটক তুলনামূলক কম, স্থানীয় পর্যটকদের একটা বড় অংশ যেতে চায় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েও পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে কোনো কার্পণ্য রাখেনি।
পর্যটন মানে হলো অবকাশ উদযাপন। ছুটি শেষ হলেই মানুষ ফিরে আসে যার যার জীবনে। সেখানে চেনা দুঃখ ও চেনা সুখ। বেড়াতে গিয়ে মানুষ ফেলে আসে কথা আর গানের কত মুহূর্ত। কক্সবাজারে বেলাভূমির ভেতর থেকে চারদিকে মাথাচাড়া দিয়েছে বহুতল কংক্রিট। একই অবস্থা হতে চলেছে কুয়াকাটায়। কিন্তু এত এত যে দালান, সেখানে একজন পর্যটকের সান্ধ্যজীবন কোথায়?
সারা দেশে আমাদের কত কবি ছিলেন, শিল্পী ছিলেন, বাউল ছিলেন, কত অবাক করা মানুষ ছিলেন। তাঁদের লেখা চিঠি, আঁকা ছবি বা ব্যবহৃত কত কী ছিল। কিছুই কোথাও বেঁচে নেই যে মানুষকে দেখাব আমরা। এমন সর্বভুক প্রাণী আমরা যে বরিশালে কবি জীবনানন্দের বাড়ির এক খণ্ড কাঠও এখন অবশিষ্ট নেই। ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য যে অধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সারা দেশে খোদিত, তার সংরক্ষণে তেমন যত্নের ছোঁয়া নেই কোথাও। পর্যটন প্রকল্প তৈরি হয়, কিন্তু কোনো প্রকল্পেই ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির কথা তুলে ধরার প্রচেষ্টা থাকে না।
তবুও মানুষ যায়, যেতে চায়। কিন্তু যারা যায়, তারা কষ্ট করে থাকে আর ফিরে আসে। প্রভাবশালী হলে সবকিছু আছে এ দেশে। আর কারো জন্য কিছু নেই। কত যে কথা, কত যে পরিকল্পনা। আগামীর কথা শুধুই গল্প। বর্তমানের প্রশ্নটাই বড়। কষ্ট করে যে পর্যটক পঞ্চগড় যাবেন, কিশোরগঞ্জ যাবেন, কৌতূহল নিয়ে যিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে গোপালগঞ্জ উপস্থিত হবেন, শেরেবাংলা সম্পর্কে জানতে বাকেরগঞ্জ যাবেন বা বরিশালের যোগেন মণ্ডল সম্পর্কে জানতে চাইবেন, যাঁরা ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাইবেন, তাঁরা কি সামান্য মানের কোনো সেবা আশা করতে পারেন? আশা হয়তো করবেন, কিন্তু পাবেন না।
নিষ্প্রভ পর্যটনে আশা জাগানোর মতো কোনো বার্তা কোথাও নেই।
লেখক : সাংবাদিক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা