ইসরায়েলি হামলা-বিধিনিষেধে রেকর্ড পতনে ফিলিস্তিনের অর্থনীতি
ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ, চলমান অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে এমনই চিত্র উঠে এসেছে।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন (আঙ্কটাড)–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই বছরের ইসরায়েলি সামরিক অভিযান ও দীর্ঘদিনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা মিলে ফিলিস্তিনকে এমন এক অর্থনৈতিক মন্দায় ঠেলে দিয়েছে, যা ১৯৬০ সালের পর বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ১০টি অর্থনৈতিক পতনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। খবর আল জাজিরার।
প্রতিবেদনটি জানায়, অবকাঠামো, উৎপাদন খাত ও জনসেবায় ব্যাপক ক্ষতির ফলে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কয়েক দশকের উন্নয়ন অগ্রগতি পুরোপুরি উল্টে গেছে। গাজা উপত্যকাকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের’ মুখোমুখি বলা হয়েছে।
এমন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, যখন ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসসহ ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলে এক হাজার ১৩৯ জন নিহত ও প্রায় ২৪০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ইসরায়েল গাজায় তীব্র বোমাবর্ষণ এবং ১৬ বছরের অবরোধকে পরিণত করে পূর্ণ অবরোধে।
আঙ্কটাডের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৯ হাজার ৭৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। গত মাসে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেও ৩০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
জিডিপিতে ভয়াবহ পতন
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালের শেষে ফিলিস্তিনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০১০ সালের স্তরে নেমে গেছে। মাথাপিছু জিডিপি ২০০৩ সালের অবস্থায় ফিরে গেছে—মানে মাত্র দুই বছরেই ২২ বছরের উন্নয়ন মুছে গেছে।
শুধু গাজাতেই ২০২৪ সালে জিডিপি আগের বছরের তুলনায় ৮৩ শতাংশ কমেছে। দুই বছরে মোট পতন দাঁড়িয়েছে ৮৭ শতাংশে, যা নামিয়ে এনেছে মোট জিডিপিকে মাত্র ৩৬২ মিলিয়ন ডলারে। মাথাপিছু জিডিপি কমে দাঁড়িয়েছে ১৬১ ডলার— যা বিশ্বের সর্বনিম্নের অন্যতম।
দুই দশকের ইসরায়েলি অবরোধ গাজাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। ইসরায়েলি হামলায় প্রায় এক লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে—যাকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত হওয়া।
পাশাপাশি, পশ্চিম তীরও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য সংকট ও চাকরি হারিয়ে অর্থনীতি সেখানে কার্যত স্থবির।
রাজস্ব আটকে রাখায় সংকট আরও গভীর
ইসরায়েল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) পাওনা প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার কর–রাজস্ব আটকে রেখেছে, যা সরকার পরিচালনা, বেতন প্রদান, জনসেবা বজায় রাখা ও পুনর্গঠনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
আঙ্কটাড বলছে, এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি অর্থনীতি তার রেকর্ডকৃত সবচেয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছে।
পুনর্গঠনে লাগবে ৭০ বিলিয়ন ডলার
সংস্থাটি অনুমান করছে, শুধু গাজাকেই পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারে ব্যয় হবে ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত আন্তর্জাতিক সহায়তা, কর-রাজস্ব ফেরত দেওয়া এবং চলাচল–বাণিজ্যে তাৎক্ষণিক শিথিলতা।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে বলেছে, বড় ধরনের আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এই ধ্বংসযজ্ঞ ফিলিস্তিনি অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতায় ঠেলে দেবে। এমনকি যথেষ্ট সহায়তা পেলেও ২০২৩ সালের আগের জিডিপি স্তরে ফিরতে সময় লাগবে বহু দশক।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, অক্টোবরের যুদ্ধবিরতিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে এবং মানবিক সংকট মোকাবিলা, অর্থনৈতিক পতন রোধ এবং স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক