তালেবান ইস্যুতে যে কারণে ভারতকে সামনে আনছে পাকিস্তান
আফগানিস্তান সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ব্যর্থ শান্তি আলোচনার পর পাকিস্তান আবারও দোষ চাপাচ্ছে তৃতীয় পক্ষ ভারতের ওপর।
২৮ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ‘ভারত আফগান তালেবান নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করেছে।’ তার মতে, এই কারণেই পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে। খবর আল জাজিরার।
খাজা আসিফ আরও বলেন, ‘ইস্তাম্বুলে আলোচনায় অংশ নেওয়া তালেবান নেতারা আন্তরিক ছিলেন, কিন্তু কাবুলে যারা সুতো টানছে, তাদের রিমোট কন্ট্রোল দিল্লির হাতে। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে নিম্নমাত্রার যুদ্ধ চায়, আর সে লক্ষ্যেই কাবুলকে ব্যবহার করছে।’
তবে আসিফ তার এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেননি। তবুও তার মন্তব্য পাকিস্তানের একটি বাড়তে থাকা কূটনৈতিক কৌশলকেই প্রতিফলিত করছে—যেখানে আফগানিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে তুলে ধরা হচ্ছে ভারত-তালেবান ঘনিষ্ঠতার ফল হিসেবে।
ভারত-আফগান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অস্বস্তি
গত কয়েক মাসে কাবুল ও নয়াদিল্লির সম্পর্কের উষ্ণতায় ইসলামাবাদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি যখন উত্তর আফগানিস্তানে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তখন প্রথম ত্রাণ পাঠানো দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ফোনে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাক্কিকে সহায়তার আশ্বাস দেন এবং ১৫ টন খাদ্যসামগ্রী পাঠান।
এছাড়া, অক্টোবরেই মুতাক্কি ভারতের ছয় দিনের সফর শেষ করেন। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর এটাই ছিল প্রথম উচ্চপর্যায়ের সফর।
ভারত তার বন্ধ থাকা কাবুল দূতাবাস পুনরায় চালু করেছে এবং উন্নয়ন সহায়তাও পুনরায় শুরু করেছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান এখন একই সময়ে দু’দিকের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে—পূর্বে ভারত ও পশ্চিমে আফগানিস্তান।
কেন পাকিস্তান ভারতকে দায়ী করছে
পাকিস্তান দাবি করছে, আফগান তালেবান তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা পাকিস্তানে বহু হামলা চালিয়েছে। ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে, এই টিটিপিকে ভারত অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে—যদিও কোনো প্রকাশ্য প্রমাণ এখনো দেখানো হয়নি।
অন্যদিকে, তালেবান নেতৃত্ব ও ভারত দু’জনেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবুও পাকিস্তান এখন প্রতিটি নিরাপত্তা ইস্যুতেই ভারতকে ‘ছায়া শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন করছে—হোক তা বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদ, কিংবা টিটিপির হামলা।
সাবেক কূটনীতিক আসিফ দুররানি বলেন, ‘ভারত এখন আফগানিস্তানে কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তারা সরাসরি নির্দেশ না দিলেও পারস্পরিক স্বার্থে তালেবানের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।’
‘ভারতের লেন্সে আফগানিস্তান’
আন্তর্জাতিক সংকটগোষ্ঠীর বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক নীতি আফগানিস্তানকে সবসময় ভারতের চোখে দেখে। আফগানিস্তান নিজে হুমকি নয়, কিন্তু ভারতের উপস্থিতি এটিকে একটি কৌশলগত ঝুঁকিতে পরিণত করে।’
ইব্রাহিম বাহিস আরও যোগ করেন, ‘পাকিস্তান যখন বলে ভারত একই সঙ্গে তালেবান ও বালুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, সেটা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ দুটি গোষ্ঠীই আদর্শগতভাবে একে অপরের বিপরীত।’
বাড়ছে সীমান্ত উত্তেজনা
মে মাসের যুদ্ধবিরতির পরও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা থামেনি। উভয় দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘বিমান ধ্বংস’ ও ‘সামরিক সাফল্যের’ দাবি তুলেছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সতর্ক করে বলেছেন, ‘সির ক্রিক এলাকায় কোনো আগ্রাসন হলে ইতিহাস ও ভূগোল বদলে যাবে।’
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যদি নতুন সংঘাত শুরু হয়, তার পরিণতি ভারত যা ভাবছে তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ হবে।’
দুই দেশই এখন আরব সাগরে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে এবং সীমান্তে বাহিনী মোতায়েন বাড়িয়েছে।
‘সুবিধা’ নাকি নতুন জোট?
ইসলামাবাদের বিশ্লেষক আমিনা খান মনে করেন, পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আশা করেছিল তালেবান ভারতের জন্য কোনো জায়গা রাখবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
আমিনা খান বলেন, ‘পাকিস্তান-আফগান সম্পর্ককে স্বাধীনভাবে দেখতে হবে, ভারতের প্রভাবকে সবসময় মাঝখানে টেনে আনা উচিত নয়।’
তবুও তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘কাবুল ও নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলো, যেখানে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষক’ বলা হয়েছে, তা একধরনের ‘স্বার্থের মিলন’ বা সুবিধার বিয়ে তৈরি করছে।’
আগামীর আশঙ্কা
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত সিমা ইলাহী বালুচ বলেন, ‘ভারত ও আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠতা ইসলামাবাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগামী দিনে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধ আরও তীব্র হবে—এমনকি নতুন সংঘর্ষও অস্বীকার করা যায় না।’
সব মিলিয়ে, পাকিস্তান এখন তার পুরনো শত্রু ভারতকে আফগান ইস্যুতেও কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক