মোদির ‘ডিয়ার ফ্রেন্ড’ থেকে কীভাবে ‘ফিয়ার ফ্রেন্ড’ হলেন ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক এড়িয়ে চলছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যনীতি, প্রতিরক্ষা চুক্তি, রাশিয়া ইস্যু ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অবস্থান নিয়ে তৈরি হওয়া মতপার্থক্য মোদি-ট্রাম্প সম্পর্ককে বেশ জটিল করে তুলেছে।
ভারতের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ শুল্ক আরোপ করার পর থেকেই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও ওষুধ শিল্পে বাড়তি শুল্ক আরোপ করে, যা ভারতের রপ্তানি খাতে বড় ধাক্কা দেয়। এরই মধ্যে ভারতও প্রতিক্রিয়া হিসেবে কয়েকটি মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে।
রাশিয়া ইস্যুতে মার্কিন চাপ
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি সহযোগিতা দীর্ঘদিনের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভারসারিজ থ্রু স্যাংশনস অ্যাক্ট’ (সিএএটিএসএ) অনুযায়ী রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনলে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
মোদি সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে— ‘ভারত নিরাপত্তা নীতির ক্ষেত্রে অন্য দেশের নির্দেশ গ্রহণ করবে না।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থানই ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক দূরত্ব বাড়িয়েছে।
আরও পড়ুন : কানাডার পণ্যে নতুন করে শুল্ক বাড়ালেন ট্রাম্প
এছাড়াও রাশিয়া থেকে তেল কেনার ফলেও নরেন্দ্র মোদির প্রতি ক্ষুব্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বারবার ভারতকে হুমকি দিয়েছেন যাতে করে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে। কিন্তু ভারত এই হুমকিতে কর্ণপাত করেনি।
ভিসা ও অভিবাসন নীতি
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতেও ক্ষুব্ধ নয়াদিল্লি। আইটি খাতের হাজারো ভারতীয় পেশাজীবী যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেন, যাদের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নীতিমালা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত সরকার বারবার অনুরোধ করলেও এ বিষয়ে ওয়াশিংটন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি।
ট্রাম্পের মন্তব্যে ক্ষোভ
সম্প্রতি এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প ভারতকে ‘বাণিজ্যে কঠিন দেশ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ভারত আমাদের সঙ্গে বাণিজ্যে সুবিধা নিচ্ছে।’ দিল্লিতে এই মন্তব্য ব্যাপক সমালোচিত হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই বক্তব্য দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি অসম্মান।’
আসিয়ান সম্মেলনে শীতলতা
মালয়েশিয়ায় আসিয়ান সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যোগ দিলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সম্মেলনে সরাসরি যোগ দিচ্ছেন না। তার ভার্চুয়ালি যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়াও এপেক সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যোগ দিলেও নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ভারতের অবস্থান
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, ‘ভারত সবসময় কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রাখবে। তবে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও কৌশলগত স্বাধীনতা নিয়ে কোনো আপস হবে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মোদির এই কৌশল ট্রাম্পের প্রশাসনের প্রতি যে বার্তা দেয় তা হলো— ভারত নিরপেক্ষ কূটনীতিতে বিশ্বাসী এবং কোনো বৈশ্বিক শক্তির চাপে মাথা নত করবে না।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, মোদি সরকার অভ্যন্তরীণভাবে মনে করছে যে ট্রাম্পের অস্থির ও অনিশ্চিত নীতি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক অবস্থানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই আপাতত ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না বাড়িয়ে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের নীতিতেই থাকছে নয়াদিল্লি।
আরও পড়ুন : গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে কাতারের ভূমিকার প্রশংসা করলেন ট্রাম্প
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত এক বিশাল জনসমাবেশে মোদি ট্রাম্পকে তার ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ বা ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে অভিহিত করেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
প্রচারণাটি অনুষ্ঠিত হয় টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনে। ওই সময় প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি ভারতীয়-আমেরিকান নাগরিক সেখানে অংশ নেন। সমাবেশে ট্রাম্প ও মোদি একসঙ্গে মঞ্চে উঠে পারস্পরিক প্রশংসা বিনিময় করেন।
মোদি বলেন, ‘আজ আমি এমন এক বন্ধুর সঙ্গে রয়েছি, যিনি আমেরিকার উন্নয়ন যেমন চান, তেমনি ভারতকেও এগিয়ে যেতে দেখতে চান — তিনি আমার প্রিয় বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প।’
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয় লাভের পর থেকে ভারতের ওপর শুল্কের কষাঘাত নেমে আসে। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে ভারতকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তাহলে মোদির ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ‘মাই ফিয়ার ফ্রেন্ড’ এ পরিণত হলেন — সময়ই তা বলে দেবে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক