ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় গাজা, যুদ্ধবিরতি নাকি সাময়িক স্বস্তি?

গাজা উপত্যকার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টােবর) সন্ধ্যায় এক ধরনের সতর্ক স্বস্তির আবহ। ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর কার্যকর হতে যাওয়া যুদ্ধবিরতি নিয়ে তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকে একে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন। কেউ আনন্দিত, আবার কেউ শঙ্কিত—এ স্বস্তি যেন আগের মতো স্বল্পস্থায়ী না হয়, যা ইসরায়েল অতীতে বারবার ভঙ্গ করেছে। খবর আল জাজিরার।
এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প “ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের স্থায়ী সমাধান” হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইসরায়েল জানিয়েছে, মন্ত্রিসভার অনুমোদনের ২৪ ঘণ্টা পর থেকে তারা গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করবে। বৃহস্পতিবার বিকেলে চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
৬২ বছর বয়সী নাসের আল-কিরনাওয়ি হাতে পুরোনো একটি রেডিও নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বসেছিলেন। টানা দুই বছর ধরে তিনি এই রেডিওর মাধ্যমে খবর শুনছেন। আজকের খবর যেন তাকে একটু আশার আলো দেখিয়েছে।
নাসের আল-কিরনাওয়ি বলেন, “গতকাল সকাল পর্যন্ত খবরটা খারাপ ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছুটা ভালো। শান্তির কথা সবাই বলছে, কিন্তু নেতানিয়াহু বলেননি। তবুও মনে হচ্ছে, ট্রাম্প যদি সই করেন, তবে সেটাই হবে।”

গাজার অনেকেই এখন ট্রাম্পের দিকে তাকিয়ে আছেন—কেউ তার কূটনৈতিক সক্ষমতায় ভরসা করে, আবার কেউ নেতানিয়াহুর প্রতি গভীর অবিশ্বাস থেকে।
বুরেইজ শরণার্থী শিবির থেকে বাস্তুচ্যুত খামিস ওসমান বলেন, “নেতানিয়াহু এক ভণ্ড বিশ্বাসঘাতক। সে শুধু নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য এই চুক্তিকে ব্যবহার করছে। ইসরায়েল আবারও হামলা চালাবে।”
গত জানুয়ারিতে হামাস ৩৩ জন ইসরায়েলি ও ৫ জন থাই নাগরিককে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে গাজায় নতুন করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
ওসমান বলেন, “যদি তারা সত্যিই তাদের বন্দিদের নিয়ে চিন্তা করত, তবে তাদের ওপরই হামলা চালাত না।”
তবুও তিনি অপেক্ষায় আছেন—“শুক্রবার (১০ অক্টােবর) যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে বলে শুনেছি, ইনশাআল্লাহ সেটাই হবে।”
৬০ বছর বয়সী ইলহাম আল-জানিন (উম মাহদি) পাঁচ সন্তান ও ১০ নাতি-নাতনিকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাস্তুচ্যুত। তিনি আনন্দিত, কিন্তু একই সঙ্গে ভীষণ বিমর্ষ—কারণ, যুদ্ধবিরতি হলেও তারা নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারবেন না।
ইলহাম আল-জানিন বলেন, “জানুয়ারির বিরতির সময় আমরা বেইত হানুনে ফিরেছিলাম। কিন্তু আমাদের ঘর তখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাই আবার ফিরে আসতে হয়েছে।”
তার চোখে জল—“সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা সবাই কষ্টে আছি। আল্লাহ সবাইকে সহ্যশক্তি দিন।”
তার চাচাতো বোন ইতিদাল আল-জানিন (উম মুহাম্মদ) বলেন, “আমাদের নাতিরা এখন আর খেলাধুলা করে না। তারা ছুরি নিয়ে পানি বিক্রি করতে যায়। অনেক সময় এসে বলে—‘দাদি, আমরা আজ লাশের টুকরো দেখেছি।’”

উম মাহদি যোগ করেন, “আগামী দিনগুলোতে আমরা আরও জানতে পারব কতজন শহীদ হয়েছে, কতজন আহত, কতজন এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে।”
গাজার সবাই এখন আশা আর অবিশ্বাসের মধ্যে একপ্রকার দোটানায়। কেউ কেউ বলছেন, রক্তপাত বন্ধ হলেও শান্তি এখনো দূরের স্বপ্ন।
ওসমান বলেন, “প্রতিবারই বলে—চুক্তি হয়েছে, তারপর আবার ব্যর্থ হয়। আশাবাদ এখন ছায়ার মতো।”
উম মাহদি বলেন, “ইসরায়েলকে বিশ্বাস করা যায় না। লেবাননে তারা এখনো প্রতিদিন হামলা চালায়। আমরা চাই মধ্যস্থতাকারীরা অন্তত আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক।”
উম মুহাম্মদ বলেন, “আমাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে গেছে। সন্তানেরা মারা গেছে, ঘরবাড়ি নেই। তবুও অন্তত রক্তপাত থামছে—এইটুকু শান্তি।”
৬২ বছরের নাসের আল-কিরনাওয়ি তার রেডিও শক্ত করে ধরে বলেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ আবার ঘরে ফিরবে। ইনশাআল্লাহ, যুদ্ধ শেষ।”
নাসের আরও বলেন, “এই যুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বাস্তুচ্যুত করা। এখন যুদ্ধ শেষ—তারা তাদের সুযোগ হারিয়েছে।”