ফরিদা পারভীনের প্রয়াণ
সুরসম্রাজ্ঞীর ৫৫ বছরের যাত্রার ইতি

ফরিদা পারভীনের নাম উচ্চারিত হলে সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে ওঠে লালনের গান, আধ্যাত্মিক দর্শনের সুর আর এক অনন্য কণ্ঠের গভীরতা। তিনি শুধু একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন লালনসঙ্গীতের জীবন্ত ভাণ্ডার। তাঁর প্রয়াণ মানে কেবল একজন শিল্পীর বিদায় নয়, বরং এক ঐতিহ্যের, এক ধারার, এক আধ্যাত্মিক সুরলোকের বড় শূন্যতা।
বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ‘লালনকন্যা’ নামে ডেকেছে। লালনের গানকে তিনি যেভাবে গেয়েছেন, তাতে শুধু সুরই নয়, দর্শনের গভীরতাও প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কণ্ঠে লালনের গান ছিল মগ্নতার এক অভিজ্ঞতা, যা শ্রোতাকে করে তুলত ভাবুক।
২০০১ সালে জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনের গান পরিচিত করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় গান শোনানো তিনি প্রমাণ করেছেন, আঞ্চলিক এক গানের ধারা কীভাবে বৈশ্বিক শিল্পরূপ নিতে পারে। তাঁর কণ্ঠে লালনের দর্শন হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন মানবতাবাদের ভাষা।
ফরিদা পারভীনের রক্তেই ছিল গান। দাদির গানের ঐতিহ্য, বাবার আগ্রহ আর নিজস্ব মেধা মিলে তিনি সঙ্গীতে আলাদা পথ তৈরি করেছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাজশাহী বেতারে নজরুলসংগীত দিয়ে শিল্পীজীবন শুরু। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁর আত্মিক বন্ধন তৈরি হয় লালনের সঙ্গে। কুষ্টিয়ার মাটিতে, মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছ থেকে লালনের গান শেখার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন একেবারেই অন্য মোড় নেয়।
লালনের গান কেবল সুর বা ছন্দ নয়, এর মধ্যে রয়েছে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজ-সংস্কার ও আধ্যাত্মিক সাধনার আহ্বান। ফরিদা পারভীন তাঁর অসাধারণ গায়কী দিয়ে লালনের গানকে তুলে ধরেছেন আধুনিক সময়ের মানুষের কাছে। তাঁর কণ্ঠে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বা ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ গানগুলো যেন নতুন প্রাণ পেয়েছিল।
শ্রোতাদের কাছে ফরিদা পারভীনের গাওয়া লালনগীতি শুধু সংগীত নয়, হয়ে উঠেছিল জীবনদর্শন।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩), আন্তর্জাতিক ফুকুওয়াকা পুরস্কার (২০০৮)। এগুলো ছিল তাঁর প্রতিভার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। কিন্তু সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি এসেছে মানুষের ভালোবাসা থেকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর গান শুনে বেড়ে উঠেছে।
ফরিদা পারভীন কেবল গানেই থেমে থাকেননি। তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’, যার লক্ষ্য ছিল লালনের গান সংরক্ষণ, স্বরলিপি তৈরি ও বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভ গড়ে তোলা। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, নিজের জীবনের বাইরে গিয়ে একটি ধারার দীর্ঘমেয়াদি উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
কিডনি জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে তিনি ভুগছিলেন। অবশেষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারাল এক অসাধারণ শিল্পীকে, যিনি আঞ্চলিক সংগীতকে আন্তর্জাতিক আসরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
আজ যখন আমরা ফরিদা পারভীনের প্রয়াণের শোক বহন করছি, তখন আমাদের ভাবা উচিত তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার নিয়ে। লালনের গান শুধু সংগীত নয়, এটি মানবমুক্তির এক দর্শন। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ সেই দর্শনকে দিয়েছে ছন্দ, সুর, আর আবেগ। তাঁর চলে যাওয়া বড় ক্ষতি, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া গান চিরকাল আমাদের মনের ভেতরে বেঁচে থাকবে।