যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় হামলা করলে কী হবে?
ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা বাড়ছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্থল অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বার্তা দিয়েছেন, তবে তিনি সিআইএ-এর গোপন অভিযানের অনুমোদন দিয়েছেন। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো দাবি করেছেন, ট্রাম্প তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে চাইছেন এবং যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলায় আক্রমণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশ কয়েকটি সামরিক বিকল্প রয়েছে, যার বেশিরভাগই স্থলবাহিনীর পরিবর্তে বিমান ও নৌবাহিনী ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমেরিকা ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ডের মতো বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী জাহাজসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিমান ও নৌবাহিনী মোতায়েন করেছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেরিন কর্পস কর্নেল মার্ক ক্যানসিয়ান আল জাজিরাকে বলেছেন, ভেনেজুয়েলার তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় প্রথম আক্রমণটি সম্ভবত আকাশ ও সমুদ্র থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ছোড়া হবে।
ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে মাদক চক্রের সঙ্গে সংযোগের অভিযোগ তোলায় বিশ্লেষকরা মনে করেন, কথিত কার্টেল-সংযুক্ত অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করা আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায্যতা প্রমাণ করা সহজ হবে।
প্রায় সব বিশেষজ্ঞই মনে করেন, বৃহৎ পরিসরে স্থল আক্রমণ অসম্ভব। বড় ধরনের স্থল অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত শক্তিশালী মার্কিন স্থলবাহিনী এই অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়নি এবং এটি আমেরিকায় রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় হবে। বিশেষজ্ঞরা সীমিত শক্তি প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন, বৃহৎ পরিসরের ‘ইরাক-ধাঁচের আক্রমণ’-এর মতো নয়।
ভেনেজুয়েলার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, সামরিক হামলা সরকার পরিবর্তনের চেয়েও বেশি জাতিকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ওরিনোকো রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস ফেরার আক্রমণের ধারণাকে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খোলার মতো বর্ণনা করেছেন। এর ফলে সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী দেশের কিছু অংশ দখল করার চেষ্টা করতে পারে।
এই ধরনের সহিংস পরিবেশে ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক বিরোধী দল সবচেয়ে কম লাভবান হবে, কারণ তাদের সশস্ত্র শাখা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ নেই।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, সীমিত মার্কিন হামলাও স্বল্পমেয়াদে মাদুরো সরকারকে শক্তিশালী করতে পারে। বহিরাগত আগ্রাসন ক্ষমতাসীনদের ভিন্নমতকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করার একটি শক্তিশালী অজুহাত দেবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরাক ও লিবিয়ার মতো উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে জোরপূর্বক হস্তক্ষেপ খুব কমই স্থিতিশীল গণতন্ত্র তৈরি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশল
সিএসআইএসের অবসরপ্রাপ্ত মেরিন কর্পস কর্নেল ক্যানসিয়ান বলেছেন, সিআইএ-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মাদুরো সরকারের প্রতি ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীর আনুগত্যকে দুর্বল করার জন্য কাজ করছে। তারা হয়তো সামরিক বাহিনীগুলোকে এই ইঙ্গিত দিতে পারে যে, যদি তারা প্রতিরোধ না করে, তবে যেকোনো যুদ্ধের সময় তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হবে না। যদিও ক্যানসিয়ানের মতে, ভেনেজুয়েলা সরকার সামরিক বাহিনী থেকে যেকোনো বিরোধিতাকে আগেই দমন করেছে। ফলে সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনী লড়াই করবে এমন সম্ভাবনা বেশি।
ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া
সামরিক বাহিনী কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা নির্ভর করে আক্রমণের আগে আমেরিকা তাদের কী সংকেত পাঠায়। ওয়াশিংটনের সামনে দ্বিধা হলো— তারা কি সামরিক কর্মকর্তাদের তাদের পদ ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ দেবে, নাকি ইরাকের মতো সব অফিসারকে সরিয়ে দেবে? সশস্ত্র বাহিনীকে প্রান্তিককরণের ফলে আরও বেশি সহিংসতা ও সারা দেশে সংঘাত শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা।
সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া
সাধারণ ভেনেজুয়েলারা ইতোমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক পতন, অতি মুদ্রাস্ফীতি ও মানবিক সংকটে ভুগছেন। এই অবস্থায়, মার্কিন আক্রমণকে তারা ‘মুক্তির’ মুহূর্তের চেয়ে নিরাপত্তাহীনতার আরও একটি স্তর হিসেবে দেখতে পারে, যা খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য মৌলিক পরিষেবা পাওয়ার সুযোগকে হুমকির মুখে ফেলবে। জনমত জরিপ সরকার ও বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ— উভয়ের প্রতিই গভীর অবিশ্বাস দেখায়।
আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতিক্রিয়া
চীন : ভেনেজুয়েলার অন্যতম বৃহত্তম ঋণদাতা চীন, মাদুরোর প্রতি দৃঢ় কূটনৈতিক সমর্থন বজায় রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে, যদিও সশস্ত্র সংঘাত শুরু হলে তাদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা সীমিত হবে।
রাশিয়া : মস্কোর ভেনেজুয়েলার সাথে সরাসরি সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়া উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং সামরিক পরামর্শ দিতে পারে। তবে উভয় দেশই রাজনৈতিকভাবে মাদুরোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।
আঞ্চলিক প্রভাব
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ভেনেজুয়েলায় যা ঘটছে, তা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটকে ‘মাদক-সন্ত্রাসবাদী’ হুমকি হিসেবে দেখানোর জন্য একটি বৃহত্তর কৌশল হতে পারে। এই ধরনের লেভেল ব্যবহার করে সামরিক পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়া যেতে পারে। এই মডেলটি আন্তর্জাতিক আইনে বল প্রয়োগের সীমিত নিষেধাজ্ঞাকে আরও ক্ষয় করতে পারে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক