বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ শিশু টাইফয়েড টিকার আওতায় : ইউনিসেফ
বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ শিশুকে টিকার আওতায় আনা টাইফয়েড প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী জাতীয় অর্জন বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্সের বিবৃতি বলেন, “একটি দারুণ খবর জানাতে পেরে আজ আমি গর্ব ও আনন্দ বোধ করছি- বাংলাদেশ একটি অসাধারণ অর্জন করেছে: টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) ক্যাম্পেইন ২০২৫-এর মাধ্যমে ৯৭ শতাংশের বেশি শিশুর কাছে পৌঁছানো গেছে, অর্থাৎ ৪ কোটি ২৫ লাখের বেশি শিশুকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই অসামান্য অর্জন প্রমাণ করেছে যে, শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ও কষ্ট থেকে সুরক্ষা দিতে এবং সন্তান গুরুতর অসুস্থ হলে পরিবারগুলো যে অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে, তা থেকে পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন টাইফয়েড প্রতিরোধে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর কাতারে এসেছে- জীবনরক্ষাকারী এই ক্যাম্পেইন চালু করা বিশ্বের অষ্টম দেশ এখন বাংলাদেশ।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “এই টিকা কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন শিশুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা সর্বশেষ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) তে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাত্র ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের নিরাপদ ব্যবস্থাপনার আওতায় পানি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, পানির সব ধরনের উৎসের প্রায় অর্ধেক (৪৭ দশমিক ২ শতাংশ) এবং প্রতি ১০টির মধ্যে আটটি পরিবারে ব্যবহৃত পানির নমুনায় (৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ) ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া দূষণ রয়েছে। এসব সংখ্যা এটাই বোঝায় যে, লাখ লাখ শিশুর জন্য টাইফয়েডের মতো অসুখে আক্রান্ত হওয়া খুবই সহজ। তারা প্রতিটি দিন এই ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে এবং সাধারণ এক গ্লাস পানিই তাদের জন্য ভয়ানক বিপদ নিয়ে আসতে পারে। এ কারণে ইউনিসেফ এ ক্যাম্পেইন শুরু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে জরুরিভাবে সহায়তা করে। প্রতিটি পরিবারের জন্য পরিষ্কার, নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত শিশুদের গুরুতর অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা প্রদান, তাদের ভবিষ্যতের সুরক্ষা এবং বাবা-মায়েদের দুশ্চিন্তামুক্ত রাখার জন্য আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী যেসব সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা দিতে পারি, তার মধ্যে টিসিভি টিকা অন্যতম।”
“টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে জোরালোভাবে সাড়া দেওয়ার জন্য আমি অভিভাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে, তারা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। টিকা দেওয়ার লক্ষ্য পূরণে সফলতা অর্জনের জন্য আমি বাংলাদেশ সরকার, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সারা দেশের তাদের অসাধারণ দলগত প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাই। এই যাত্রার প্রতিটি ধাপে সহায়তা করার জন্য ইউনিসেফ সম্মানিত বোধ করছে। এখানে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিসিভি টিকা সরবরাহ করা থেকে শুরু করে জোরদার পরিকল্পনা, নতুন কোল্ড রুম স্থাপনের মাধ্যমে কোল্ড চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সঠিক সময়ে সঠিক শিশুর কাছে টিকা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে ভ্যাক্সইপিআই (VaxEPI) প্ল্যাটফর্মের মতো ডিজিটাল টুলের ব্যবহার করা হয়েছে- এগুলোর প্রতিটিতে সহায়তা করেছে ইউনিসেফ। এ ধরনের একটি বিশাল জাতীয় ক্যাম্পেইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে আমরা দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করেছি।”
“যোগাযোগ (কমিউনিকেশন) ও স্থানীয়দের যুক্ত করার (কমিউনিটি এনগেজমেন্ট) প্রচেষ্টাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এবং টিভি, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আস্থা তৈরি করার মতো শিশুবান্ধব বিভিন্ন বার্তা প্রচার করে আমরা ১২ কোটির বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি এবং সন্তানদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে পরিবারগুলো যাতে আস্থা রাখতে পারে সেজন্য তাদের সহায়তা করেছি।
“যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হলো সব জায়গায় প্রতিটি শিশুর কাছে পৌঁছানোর অঙ্গীকার। হোক তা জলাভূমি অঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা বা দুর্গম পাহাড়চূড়ায় বসবাসকারী শিশু; প্রতিবন্ধী শিশু; সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশু; ভ্রাম্যমাণ, আদিবাসী ও চা-বাগান কমিউনিটির শিশু; কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং যৌনকর্মীদের সন্তান- সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ৪ লাখ ২৪ হাজারের বেশি শিশুকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিটি শিশুর প্রতি বাংলাদেশের গভীর অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি আরও জানান,“বাংলাদেশের জনগণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কে তাদের নেতৃত্ব ও নিরলস প্রচেষ্টার জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের সহায়তার কারণেই এক সময়ে দেশের সব শিশুকে টিকা দেওয়ার এই কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই ক্যাম্পেইন সফল করার জন্য আমাদের পাশে থাকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও অন্যান্য অংশীজনদের ভূমিকাও আমরা স্মরণ করছি। আমি গণমাধ্যমকেও ধন্যবাদ দিতে চাই। যখন গুজব ও ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এমন এক সময়ে আপনাদের দায়িত্বশীল খবর প্রকাশ এবং বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করার যে প্রয়াস তা পরিবারগুলোকে নির্ভুল, আস্থাপূর্ণ তথ্য পেতে সহায়তা করেছে। আর তার মধ্য দিয়ে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, যা টিকা প্রদানের এই অসামান্য অর্জনকে সম্ভব করেছে।”

নিজস্ব প্রতিবেদক