মিডিয়ার কল্যাণে অনিয়ম-দুর্নীতি বের হয়ে আসছে
আলোচিত প্লট দুর্নীতির ছয়টি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে শেখ হাসিনাকে তিন মামলায় সাত বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার রায়ে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাজার মেয়াদ আলাদাভাবে কার্যকর হবে। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে ২১ বছর জেল খাটতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের শুরুতে বিচারক মিডিয়ার প্রশংসা করে বলেন, মিডিয়া হলো রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ। মিডিয়া সংবাদ করার কারণে রাজউকের অনিয়ম-দুর্নীতি বের হয়ে আসছে। অন্যথায় আজকে সাধারণ মানুষের পক্ষে এত বড় অনিয়ম জানা সম্ভব হতো না। সংবাদ পরিবেশনের পর পরই দুদক নড়ে চড়ে বসে। আমাদের দেশের মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করলে সমাজের অনিয়ম-দুর্নীতি কমে আসবে। একটি রাষ্ট্রের প্রধান কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে জাতির সাথে প্রতারণা করেছে। এরপর বিচারক বলেন, তিনটি রায় আমি পৃথকভাবে দিবো। তবে শেখ হাসিনার রায় তিনটি মামলায় ৭ বছর করে ২১ বছর। এটি একটির পর একটি কার্যকর হবে।
শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের প্লট বরাদ্দ নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার তিন মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণে এ কথা বলেন। প্রত্যেক মামলায় এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে আরও ছয় মাস করে মোট দেড় বছর কারাভোগের সাজা দেওয়া হয়। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎপরতা স্পষ্ট করে দেয়, সম্পদের প্রতি তার লোভ ছিল।
রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, শেখ হাসিনা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে নিয়মানুযায়ী প্লট বরাদ্দের কোনো আবেদন করেননি। কিন্তু প্লট বুঝে নিতে ঠিকই আবেদন করেছিলেন। রাজউকের বিধি অনুযায়ী, প্লট বরাদ্দ নিতে হলে অবশ্যই আবেদন করতে হয়। আবেদন না করলেও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকের প্লট বরাদ্দবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে প্লট দেওয়ার অনুমোদন দেন।
আদালত আরও বলেন, ঢাকায় বাড়ি থাকলেও প্লট বরাদ্দের জন্য বাধ্যতামূলক যে হলফনামা দাখিল করতে হয়, সেই হলফনামায় আসামিরা কিছু উল্লেখ করেননি। এমনকি হলফনামা নোটারি পাবলিক অথবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে করার বিধান থাকলেও তা করা হয়নি। আইন না মেনে হলফনামা সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে প্লট বরাদ্দের পরপরই তিনি প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য রাজউকে আবেদন করেন। ওই আবেদনের সঙ্গেও আরেকটি হলফনামা দাখিল করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সে ক্ষেত্রেও আইনের বিধিবিধান না মেনেই হলফনামা দাখিল করা হয়। আবার নিজের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে ছেলেমেয়েদের এবং তার বোন শেখ রেহানা ও তার সন্তানদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। এতে বোঝা যায়, শেখ হাসিনার সম্পদের প্রতি লোভ ছিল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শেখ হাসিনার স্বামীর নামে ১৯৭৩ সালে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তা গোপন করে শুধু তার নামে রাজধানীর কোথাও প্লট নেই মর্মে হলফনামা দাখিল করেন তিনি। শেখ হাসিনা সাধারণ কোনো নাগরিক নন। তার লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, ল মিনিস্টার, অ্যাটর্নি জেনারেল ছিল। কিন্তু তিনি কারও পরামর্শ না নিয়ে, আইন না মেনে কাজ করেছেন; যা অপরাধ হিসেবে গণ্য।
বিচারক বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি সেক্টরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। দুর্নীতিবাজদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা প্লট বরাদ্দ না নিলে ওই প্লট অন্য একজন আবেদনকারী পেতেন। ফলে শেখ হাসিনা প্রতারণা করেছেন। এ রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
আদালত রায়ে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলকভাবে সরকারি সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাই ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় তাদের শাস্তি দেওয়া হলো। এই ধারায় শাস্তি দেওয়ায় প্রতারণার অভিযোগের দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় শাস্তি দেওয়া হলো না। তবে প্লট বরাদ্দ নিয়ে পারিতোষিক নেওয়ার অভিযোগ এবং অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দণ্ডবিধির অন্যান্য ধারা থেকে সব আসামিকে খালাস দেওয়া হলো।
এই তিন মামলায় দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬৩, ১৬৪, ১৬৫ (ক), ৪০৯ ধারায় অপরাধের অভিযোগ ছিল। দুটি পৃথক মামলার একটিতে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ও অন্যটিতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, শেখ হাসিনাকে অপরাধে সহায়তা করার জন্য। দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় এই সহায়তার অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে বলে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়।
আদালত রায়ে আরও বলেন, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সব ব্যবস্থা করেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব আসামি মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন নিজে ও অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি নথি বিনষ্ট করেছেন অথবা গায়েব করেছেন মর্মে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। প্লট বরাদ্দ-সংশ্লিষ্ট রাজউক কর্মকর্তারা বেআইনিভাবে নিজেরা লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের প্লট বরাদ্দের সব ব্যবস্থা করেন। এ কারণে তাদের শাস্তি দেওয়া হলো।

নিজস্ব প্রতিবেদক