সুধা সদনের তথ্য লুকিয়ে প্লট নেন ‘রিক্ত ও নিঃস্ব’ শেখ হাসিনা, তিন মামলার রায় আজ
আলোচিত প্লট দুর্নীতির ছয়টি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলার রায় আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করবেন।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরে বড় বাধা ভারত?
সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া সুধা সদনের তথ্য গোপন, রাজউকের নির্ধারিত ফরমে আবেদন না করা, হলফনামায় অসম্পূর্ণ তথ্য দাখিলের পরও অবিশ্বাস্য দ্রুততায় রাজধানীর নতুন শহর পূর্বাচলের ডিপ্লোমেটিক জোনে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং বোন শেখ রেহানা সিদ্দিক, বোনের দুই সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও আজমিনা সিদ্দিকের নামেও বাগিয়ে নেন আরও ৫০ কাঠার প্লট। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে একাধিকবার ‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি, দেবার কিছু নাই….’ বললেও রাষ্ট্রের লক্ষ কোটি টাকা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হাসিনা পরিবার পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লটের লোভও সামলাতে পারেননি। এই দুর্নীতিতে শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করেন শেখ রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনা পরিবারের ‘পূর্বাচল জয়’
চলতি বছরের ১০ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতে প্লট দুর্নীতি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। তাতে এসব তথ্য উঠে আসে।
শেখ রেহানা, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অপর তিনটি মামলায় রায় ঘোষণার দিন ধার্য্য হয়েছে আগামী সোমবার (১ ডিসেম্বর)। প্লট বরাদ্দ পাওয়া এই ছয়জন ছাড়াও মোট ৪৭ জনকে এই ছয়টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। রাজউকের কর্মকর্তা খুরশীদ আলম ছাড়া বাকি সব আসামি বর্তমানে পলাতক আছেন।
ধানমণ্ডির সুধা সদনের তথ্য গোপন
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, আদালত ও মামলার নথি থেকে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১ মার্চ ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাড়ির একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় ড. ওয়াজেদ মিয়া তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন বরাবর একটি সরকারি প্লটের জন্য আবেদন করেন। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে ধানমণ্ডিতে ১৪ কাঠার একটি প্লট ওয়াজেদ মিয়ার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা বর্তমানে ‘সুধা সদন’ নামে পরিচিত। তখন প্লটটির মূল্য ধরা হয়েছিল ৭০ হাজার টাকা। একাধিক কিস্তিতে ওই টাকা পরিশোধ করা হয়।
আরও পড়ুন : আবেদন না করেও পূর্বাচলে প্লট পান জয়
১৯৭৫ সালে ড. ওয়াজেদ মিয়া জার্মানিতে ছিলেন। একটি বৃত্তি নিয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সে বছরের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও সেখানে যান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ২৫ আগস্ট ড. ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভারতের দিল্লিতে যান। সেখানে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় পান। দিল্লির পান্ডারা রোডে একটি বাড়িতে তাদের সাড়ে ছয় বছর কাটে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে উঠেছিলেন তার ছোট ফুফু খাদিজা খানমের লালমাটিয়ার বাসায়। ড. ওয়াজেদ মিয়া দিল্লি থেকে ঢাকায় ফেরেন ১৯৮২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় তিনি ওঠেন তার ভাগ্নিজামাই সিদ্দিক হোসেন চৌধুরীর মোহাম্মদপুরের ১১/১২ ইকবাল রোডের বাসায়। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে তিনি মহাখালীর আণবিক শক্তি কলোনিতে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান। ১৯৮২ সালেই ধানমণ্ডিতে সুধা সদনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ড. ওয়াজেদ মিয়া সপরিবারে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে ওই বাড়িতে ওঠেন। ২০০৯ সালের ৯ মে ওয়াজেদ মিয়া মারা যাওয়ার পর ওয়ারিশসূত্রে সুধা সদনের মালিক হন স্ত্রী শেখ হাসিনা, তার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। পরে শেখ হাসিনা সুধা সদনের তার নিজের অংশ দুই সন্তানকে হেবা দলিল করে দেন।
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু সুধা সদন সরকারি সম্পত্তি এবং রাজউক থেকে বরাদ্দপ্রাপ্ত, তাই এসব ব্যক্তি পুনরায় সরকারি প্লটের আবেদনের যোগ্য নন। শেখ হাসিনা পূর্বাচলে প্লটের জন্য দাখিল করা হলফনামায় সুধা সদনের এসব তথ্য সম্পূর্ণ গোপন করেন। একইভাবে তার দুই সন্তানও এসব তথ্য গোপন করেন।
আরও পড়ুন : ‘মায়ের কাছে’ পুতুলের প্লটের আবদার, ৩ দিনেই পূর্বাচলে বরাদ্দ
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রসিকিউটর খান মো. মঈনুল হাসান লিপন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, শেখ হাসিনার ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুল হলফনামা দিয়ে জানিয়েছেন, রাজউকের এরিয়া নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার কোথাও তাদের নামে এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে কোনো বাড়ি বা সম্পত্তি নেই। রাজধানীতে যদি আবেদনকারী, তাদের আত্মীয়-স্বজন বা রক্তের সম্পর্কের কারও বাড়ি থাকে, তাহলে তিনি প্লট পাবেন না। এরপরও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারা (শেখ হাসিনা-জয়-পুতুল) পূর্বাচলের প্লট নেন।
আবেদন না করেও প্লট পান শেখ হাসিনা
রাজউকের নিয়মানুযায়ী, কোনো ব্যক্তি প্লটের বরাদ্দ পেতে চাইলে তাকে রাজউকের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হয়। সে ফরমে সুপারিশের প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি ৩শ টাকার স্ট্যাম্পে আইনজীবীর মাধ্যমে নোটারি হলফনামা বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে হলফনামা দাখিল করতে হয়। হলফনামায় উল্লেখ করতে হয়, ‘ইতোপূর্বে তিনি বা তার পরিবারের কেউ সরকারি কোনো সম্পত্তি বরাদ্দ পাননি বা মালিক হননি।’
আরও পড়ুন : সুধা সদনের তথ্য লুকিয়ে প্লট নেন ‘রিক্ত ও নিঃস্ব’ শেখ হাসিনা
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, দ্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস) রুলস ১৯৬৯-এর ৯ বিধি সাপেক্ষে, ট্রাস্ট এমন ব্যক্তিকে প্লট বরাদ্দ করতে পারে, যারা সরকারি চাকরি, জনসেবা কিংবা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তবে এই বিধি অনুযায়ী কেউ নির্ধারিত ফরমে আবেদন না করলে এবং সরকার সুপারিশ না করলে তিনি বা তারা প্লট বরাদ্দ পাবেন না।
মামলার নথি ও রাজউক সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা প্লট বরাদ্দ চেয়ে রাজউকের কাছে নির্ধারিত ফরমে আবেদন জমা দেননি। বরং ২০২২ সালের ১৯ জুলাই গণপূর্ত মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনার নামে প্লট বরাদ্দ করার পদক্ষেপ নেয়। এরপর ২৬ জুলাই বোর্ড সভায় প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়ে রাজউককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পরদিন ২৭ জুলাই শেখ হাসিনাকে প্লট বরাদ্দের উদ্যোগ নেয় রাজউক।
এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা প্লট বরাদ্দের আবেদন করেন ও ৩শ টাকার স্ট্যাম্পে হলফনামা দাখিল করেন। চারদিন পর ৩১ জুলাই তার নামে প্রাথমিকভাবে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনার সেই হলফনামায় দেখা যায়, প্রথম দুই পাতায় তার স্বাক্ষর রয়েছে। শেষের পাতায় আবেদনকারির স্বাক্ষরের নির্ধারিত স্থানে তিনি স্বাক্ষর করেননি। আবার হলফনামাটি নোটারি পাবলিক করা হয়নি, স্ট্যাম্পে আইনজীবীর স্বাক্ষর ও সীলমোহর নেই। সেখানে সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া সুধাসদনের বাড়ির তথ্যও গোপন করা হয়। এসব ত্রুটি আমলে না নিয়ে ৩ আগস্ট দ্রুতগতিতে শেখ হাসিনার নামে পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমি (২৭ সেক্টরের ২৩নং রোডের, প্লট নং-৯) চূড়ান্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরের মাসের ১২ সেপ্টেম্বর কালীগঞ্জ রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নামে জমিটি রেজিস্ট্রি করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর তার কাছে দলিল হস্তান্তর করা হয়।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার লকারে পাওয়া গেল ৮৩২ ভরি স্বর্ণ
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আটজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকেরর সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। গত ৩১ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। পরে এই মামলায় মোট ২৯ জন আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। গত ২৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায়ের জন্য আজকের (বৃহস্পতিবার ২৭ নভেম্বর) দিন ধার্য করা হয়।
আরও পড়ুন : রায় ঘোষণার সময় তাসবিহ পড়ছিলেন সাবেক আইজিপি মামুন
মামলার অপর আসামিরা হলেন– জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) শফিউল হক, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) খুরশীদ আলম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) নাসির উদ্দীন, সাবেক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, সাবেক উপ-পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরিফ, জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ।
শুনানিকালে গ্রেপ্তারকৃত একমাত্র আসামি রাজউকের সদস্য খোরশেদ আলমের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম। তবে মামলার অন্য আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ ছিল না।

জাকের হোসেন