পাকিস্তানকে দোষারোপে সতর্ক ভারত, যে কারণে বদলেছে নীতি
মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে চারদিনের সীমান্তযুদ্ধের পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দিয়েছিলেন — ভবিষ্যতে যে কোনো সন্ত্রাসী হামলাকে যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
তখন কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৫ পর্যটক নিহতের ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছিল, যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। এরপর ভারত পাকিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা চালায়, পাল্টা হামলায় দুই দেশের মধ্যে স্বল্প সময়ের তীব্র সংঘাত হয়। চারদিন পর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও, মোদির সেই কঠোর মন্তব্য ভারতের জন্য নতুন এক ‘রেড লাইন’ তৈরি করে দেয়।
এরপর সোমবার (১০ নভেম্বর) ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির লালকেল্লার কাছে ভয়াবহ বিস্ফোরণে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। ঘটনাটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে তদন্ত করছে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, দোষীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
তবুও বিস্ফোরণের দুই দিন পর পর্যন্ত ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে একে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ ঘোষণা করেনি, কিংবা পাকিস্তানকে দায়ীও করেনি—যা ভারতের আগের ধারা থেকে ভিন্ন।
নিজেদের তৈরি ফাঁদে ভারত
দিল্লি বিস্ফোরণের সূত্র কাশ্মীর হয়ে পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) সঙ্গে জড়িত বলে ভারতের গোয়েন্দারা দাবি করলেও, সরকার এখন পর্যন্ত নাম প্রকাশে সংযম দেখাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পরিচালক অজয় সাহনি বলেন, মোদির সরকার নিজেদের কথায় নিজেরাই ফাঁদে পড়েছে। যখন বলা হয় সন্ত্রাস মানেই যুদ্ধ, তখন পরবর্তী ঘটনায় সেই কথার ফল ভোগ করতে হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, সরকার যদি এটিকে সন্ত্রাসী হামলা বলে ঘোষণা দেয়, তাহলে অভ্যন্তরীণ চাপ তৈরি হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার।
বিস্ফোরণের পেছনের ঘটনা
বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা আগে কাশ্মীর পুলিশ দিল্লিসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে অভিযানে ‘জইশ’ ও ‘আনসার গজওয়াত-উল-হিন্দ’ জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত একটি আন্তঃরাজ্য নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয় বলে জানায়।
তারা প্রায় দুই হাজার ৯০০ কেজি বিস্ফোরক সামগ্রী ও ডিভাইস তৈরির উপকরণ উদ্ধার করে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে অভিযুক্ত এক চিকিৎসক উমর নবি পলওয়ামা থেকে পালিয়ে যান। এখন ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা হচ্ছে তিনিই কি লালকেল্লার বাইরে বিস্ফোরিত গাড়িটি চালাচ্ছিলেন কি না।
ভারতের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠনের কাছ থেকে কিছু লজিস্টিক সহায়তা পাওয়া গেছে বটে, তবে হামলাকারীরা স্থানীয় ও স্ব-উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক বাস্তবতা
মে মাসে পাকিস্তানে বিমান হামলার সময় প্রমাণ দেখাতে না পারায় ভারত আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার ভারত তুলনামূলকভাবে সতর্ক আচরণ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কাশ্মীরভিত্তিক বিশ্লেষক শেখ শওকত বলেন, ভারত বুঝেছে যুদ্ধ সবার ক্ষতি ডেকে আনে। তাই এখন তারা আরও হিসাবি হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
দিল্লি বিস্ফোরণের একদিন পরই পাকিস্তানের ইসলামাবাদে আদালতের বাইরে আত্মঘাতী হামলায় ১২ জন নিহত হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে দায়ী করে বলেন, দিল্লি ও ওয়ানার দুই হামলাই ভারতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উদাহরণ। ভারত তা সরাসরি অস্বীকার করে।
এই সময় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনা তীব্র, যেখানে পাকিস্তান তালেবানকে ভারতের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তুলছে। অন্যদিকে, ভারত আফগান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে—যা ইসলামাবাদের দৃষ্টিতে নতুন উদ্বেগ।
যুদ্ধ ভারতের পক্ষে নয়
দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষক হর্ষ পন্ত বলেন, ভারতের কৌশল সব সময়ই সংঘাত এড়ানো। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে ভারত উন্নয়নেই মন দিতে চায়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করলে অর্থনীতি ও কৌশল—দুটো দিকেই ক্ষতি হয়।
হর্ষ পন্ত আরও বলেন, এই বিস্ফোরণ পরিকল্পিত নয় বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই ভারত প্রতিক্রিয়ায় সংযত আচরণ করছে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক