ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুর ফাঁদে পা দিলেন?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি নতুন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার ১৫০ দিনেরও বেশি সময় পর মনে হচ্ছে—ট্রাম্প তার পূর্বসূরীদের মতোই একই ফাঁদে পড়েছেন। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছেন। যার প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে থাকবে। এই হামলাগুলো এমন এক সময়ে হলো, যখন ওয়াশিংটন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি সামরিক হামলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
‘ট্রাম্প ফ্যাক্টর’ এবং নীতিগত পরিবর্তন
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহুর সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের কয়েকদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যে তার রাষ্ট্রদূত স্টিভ উইটকফ গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নেতানিয়াহুকে শক্তিশালী করার জন্য ইসরায়েলে প্রবেশ করেন। সেই সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ‘ট্রাম্প ফ্যাক্টর’ বলতেন। এর মানে হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, যেমন তার অপ্রত্যাশিত আচরণ ও চুক্তি করার দক্ষতা, যার দ্বারা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চাপ দিতে পারবে।
যদিও নেতানিয়াহু পূর্ববর্তী প্রশাসনগুলোকে এই অঞ্চলে তার সামরিক অভিযানকে সমর্থন করার জন্য রাজি করিয়েছিলেন। নেতানিয়াহুর প্রভাব প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ট্রাম্পের আছে বলে ইসরায়েলের কিছু সমালোচক তার প্রশংসা করতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু শনিবার (২২ জুন) মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানগুলো ইরানে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজের উপলব্ধিতে এক বড় পরিবর্তন এসেছে। ইসরায়েল গত সপ্তাহে ইরানে হামলা শুরুর পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি দেশটিতে আঘাত হানলো। এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারাও বিদেশনীতিতে তাঁদের পূর্বের ‘মাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী’ অবস্থান থেকে আরও যুদ্ধংদেহী অবস্থানে সরে এসেছেন।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য বিতৃষ্ণা এবং বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রকে আর কোনো সংঘাতে না জড়ানো। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ২০০ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে এই প্রতিশ্রুতি যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এই হামলাগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশনীতির নতুন দিক নির্দেশ করছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে আরও সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।
ট্রাম্পের প্রকাশ্য সমর্থন এবং নীতির পরিবর্তন
ট্রাম্প জনসমক্ষে নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি সমস্যাগ্রস্ত সম্পর্কের গুজবকে থামানোর চেষ্টা করেন। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, মার্কিন নীতি ইসরায়েলের সঙ্গে একমত ছিল, ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বোমা হামলা চালিয়ে ইসরায়েল আমেরিকাকে অন্ধ করে দিয়েছে এমন পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী বিবি নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাতে চাই। আমরা এমন একটি দল হিসেবে কাজ করেছি যা সম্ভবত আগে কখনও কাজ করেনি, আমরা ইসরায়েলের জন্য এই ভয়াবহ হুমকি মুছে ফেলার জন্য অনেক এগিয়ে গেছি।’
এটি ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলি বোমা হামলার প্রতি ট্রাম্পের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার অনেক পার্থক্য ছিল। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও হামলাগুলোকে ‘একতরফা’ বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত নয় এবং আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এই অঞ্চলে আমেরিকান বাহিনীকে রক্ষা করা।’
এক সপ্তাহের মধ্যে কত পার্থক্য তৈরি হলো! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরায়েলি হামলাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেছে এবং আক্রমণে যোগ দিয়েছে। যা সম্ভাব্যভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন এক ধারাবাহিক উত্তেজনার ক্ষেত্র তৈরি করছে।
ভবিষ্যতের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
ট্রাম্প প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে দাবি করেছেন, ফোরদো, নাতানজ এবং ইসফাহান সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুরলোতে মার্কিন হামলা এককালীন অভিযান ছিল। এটি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীকে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। ট্রাম্প তেহরানকে বলেছেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করলে আমেরিকা আরও হামলা চালাতে প্রস্তুত।
তবুও ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সসহ ট্রাম্পের নিজস্ব প্রশাসনের কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, তেহরান প্রতিশোধ নিলে ইরানে দীর্ঘমেয়াদী অভিযানে সীমিত হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। আপাতত, ট্রাম্প মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে এমন উত্তেজনা রোধ করতে পারবেন।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ট্রাম্পের অভিযানের ফলে আরও সাহসী বলে মনে হচ্ছে। নেতানিয়াহু একটি ভিডিও বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অভিনন্দন, প্রেসিডন্টে ট্রাম্প, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ ও ন্যায়নিষ্ঠ শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার আপনার সাহসী সিদ্ধান্ত ইতিহাস বদলে দেবে।’

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক