বাংলাদেশের ছন্নছাড়া ব্যাটিং আর কত দেখতে হবে?
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’— এখানে দেশের জায়গায় যদি দল ধরি এবং দলটি হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, বোধহয় ভুল কিছু হবে না। কবি কুসুমকুমারী দাসের এই লাইনের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও দিন দিন কাজের চেয়ে কথায় বড় হয়ে উঠছেন। একটু নির্দিষ্ট করে বললে, দলের ব্যাটাররা। একেকজন ভুল করতে সিদ্ধহস্ত। তা শোধরানোর বেলায় লবডঙ্কা।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ দলের কাণ্ডারি মোটামুটি বোলাররাই। এই সময়ে বাংলাদেশ যতগুলো ম্যাচ জিতেছে, তার বেশিরভাগ জয়ের কারিগর তারা। যে কয়টি জয় এসেছে, সেগুলোতেও সমর্থকদের বুকের ছটফটানি বাড়িয়ে জিতেছে বাংলাদেশ। প্রশ্ন জাগে, এভাবে আর কত?
২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ কিংবা তারও আগে থেকে বাংলাদেশ দলের এই ব্যর্থতার মিছিল চলছে। টপ অর্ডার থেকে মিডল অর্ডার—মুখ গোমড়া করে আছে সব পজিশনের ব্যাটারদের ব্যাট। শান্ত-লিটনরা এক ম্যাচ ভালো খেলেন তো, কয়েক ম্যাচ ফেরেন শূন্য হাতে। অধারাবাহিকতায় বেশ ধারাবাহিক তারা।
দেশের ঘরোয়া অঙ্গনের সবচেয়ে সফল কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। একটা সময় তাকে জাতীয় দলের কোচ বানানোর জন্য জোর দাবি উঠেছিল। সেই দাবির বাস্তবায়নও হয়েছে গত বছর। প্রায় এক বছরে সালাউদ্দিনের অধীনেই আছেন ব্যাটাররা। ফলাফল ঘুরেফিরে শূন্য। উন্নতির ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি ব্যাটারদের মধ্যে। টেকনিক্যালি কিংবা মেন্টালি আগের অবস্থানেই আছেন মিরাজ-জাকের আলীরা।
সালাউদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার পরে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে, এর মধ্যে ৯টিতেই হেরেছে। এই ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র দুটি ম্যাচে আড়াইশ বা তিনশ রান করতে পেরেছে। এর মধ্যে আবার দুইশ পেরোনোর আগেই গুটিয়ে গেছে চার ম্যাচে। অথচ টি-টোয়েন্টিতেই এখন ২০০ পেরোনো ইনিংস অহরহ দেখা যায়।
তাওহিদ হৃদয় অফসাইডে দুর্বল, এটি এখন ক্রিকেট বিশ্বে সমাদৃত। সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। কিন্তু, সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা নেই হৃদয়ের মাঝে। উল্টো সেই ব্যর্থতা নিয়ে তিনি যেন গর্ব অনুভব করেন। সেটিকে ডিফেন্ড করেন এভাবে—বিশ্বের সব বড় বড় ব্যাটারদেরই দুর্বলতা আছে।
হৃদয় কি জানেন, বিশ্বের সব বড় বড় ব্যাটাররাই দুর্বলতা কাটানোর জন্য নিবিড় অনুশীলন করেন। বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো উপায় বের করেন। হৃদয় কিছু বের করতে পেরেছেন?
হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থা জাকের আলী অনিক, নুরুল হাসান সোহানদের। অফসাইডে এই দুজনের দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। বিষয়টি এমন যে, তাদের দুর্বলতা বের করতে প্রতিপক্ষ দলের অ্যানালিস্টকে আর বিশ্লেষণ করতে হয় না।
হৃদয়-জাকেরদেরে চেয়ে টেকনিক্যালি বাকিরা একটু ভালো হলেও মানসিক দিক থেকে সবাই সমান। কখনও ভুল বোলার বাছাই, কখনও ভুল শট সিলেকশন। গুলিয়ে ফেলেন নিয়মিত। তার ওপর অতিরিক্ত ডটবল খেলে বল আর রানের হিসাব না মেলাতে পেরে জোর করে ভুল বলে ভুল শট খেলে উপহার দিয়ে আসেন উইকেট। দলকে ডুবিয়ে আসেন। লম্বা সময় ধরে চলে আসছে এই ধারা। এরপরও দৃশ্যত ব্যাটারদের কোনো জবাবদিহিতাই নাই।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডের কথাই ধরা যাক। ১৯১ রানের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সামনে। গড়ে ওভারপ্রতি ৪ রানের কম রান প্রয়োজন ছিল। সাধারণ হিসাবে ওভারে ৩-৪টি সিঙ্গেল নিলেই লক্ষ্য পূরণ হয়ে যায়। অথচ ম্যাচ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, ব্যাটারদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা পার করেছে সব সীমানা।
সহজ সমীকরণ মেলাতে গিয়ে হিমশিম খান ব্যাটাররা। অতিরিক্ত ডট বল খেলে রানরেট বাড়ান। চাপে পড়ে দল। এরপর ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানোর চেষ্টায় দিয়ে আসেন উইকেট। প্রথমে পেস, এরপর স্পিন, বাংলাদেশ কাবু হচ্ছে দুই বিভাগেই।
গত ম্যাচে যেমন আফগান স্পিনার রশিদ খানকেই উপহার দিয়েছে পাঁচ উইকেট। নুরুল হাসান সোহান, জাকের আলী, তাওহিদ হৃদয়রা মিলে রশিদকে বাউন্ডারি ছাড়া করতে গিয়ে উইকেট দিয়ে এসেছেন। ক্রিকেটীয় জ্ঞান থেকে চাইলেই সমীহ করে খেলা যেত রশিদকে। লক্ষ্য বানানো যেত বাকি বোলারদের। বাংলাদেশের ব্যাটাররা এটুকু গেমসেন্সটুকু দেখাতে পারেননি।
দ্বিতীয় ওয়ানডের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমাদের ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে হবে। যদি আমরা ওয়ানডেতে রান না করি, তাহলে টিকে থাকতে পারব না।’
সহসা যদি ব্যাটাররা এটি বুঝতে না পারে, তাহলে ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ হবে , এটা বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। ক্রিকেটারদের জন্য কত আয়োজন। মাঠে তার প্রতিফলন নেই। কবে পূর্ণ হবে ব্যর্থতার ষোলকলা? উত্তরও জানা নেই কারও।

নাজমুল সাগর