আরব আমিরাতে ফারুকের দুঃসহ জীবন
পরিবারের অভাব-অনটন দূর করতে দেশের অনেকেই পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ওই সব দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এবং সতর্কতার অভাবে অনেকে সমস্যার সম্মুখীন হন। কেউ দেশে ফিরে আসছেন। কেউ আবার ফিরে আসছেন নিঃস্ব হয়ে। আবার কাউকে বিনা দোষেই বিদেশে ভোগ করতে হয় কারাজীবন। তেমনই একজন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বিজবাগ গ্রামের বাসিন্দা মো. ফারুক আহমেদ। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। তিনি জানান তাঁর দুঃসহ জীবনের কথা। চলুন তাঁরই জবানিতে জেনে নিই সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর কথা।
ফারুক আহমেদের জবানবন্দি
‘আমি আরব-আমিরাতের শারজায় আল হাদী মনসুর কোম্পানিতে চাকরি করতাম। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর কাজ করে আসছি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। প্রথমে কোম্পানিতে গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করলেও আমার দক্ষতার কারণে ওয়াচম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় কোম্পানি। সেখানে আমার দায়িত্বে ছিল ৬০ ফ্ল্যাটবিশিষ্ট একটি বাড়ির ভাড়া দেওয়া ও দেখাশোনা করা। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ২০১৩ সালের জুন মাসে। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে বাংলাদেশি এক লোক ফ্ল্যাটের একটি রুম ভাড়া নেয়। কিছুক্ষণ পরে ওই দেশের সিআইডি নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে ওই বাড়ি তল্লাশি চালায় এবং পুলিশ ওই নারীসহ লোকটিকে আটক করে। এঁরা অবৈধভাবে মেলামেশার জন্য ফ্ল্যাটে উঠেছে এমন অভিযোগ ছিল পুলিশের। পরে ওই দুজনের সঙ্গে আমাকেও আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। আর অবৈধ পরিবারকে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
মামলা দায়ের করলেও আমাদের আদালতে ওঠানো হয় আটকের ছয় মাস পর। ততদিন আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী করব। পরে আদালতের রায়ে আমি খালাস পাই। কিন্তু আটক থাকা অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে আরো দুটি মামলা দায়ের করে ওই দেশের সিআইডি। কারণ হিসেবে জানা যায়, বিনা বিচারে ছয় মাস আটক রাখার অপরাধে সিআইডির বিরুদ্ধে আমি মামলা করতে পারি এমন আশঙ্কায় ওই সিআইডি বাদী হয়ে আমার বিরুদ্ধে আরো দুটি মামলা দায়ের করে। এতে আমার জীবন আরো বিপন্ন হয়ে ওঠে। চিন্তায়, হতাশায় আরো ভেঙে পড়ি। চিন্তার বড় কারণ হলো মামলা শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় আসতেই কয়েক মাস সময় লেগে যায়। এ ছাড়া আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য কোম্পানি আমাকে কোনো রকম সহযোগিতা করে না। এমনকি কারাগারে থাকাকালীন আমার কোনো খোঁজখবরও নিতে আসেনি। বরং আমার বাসায় থাকা সকল রকমের জিনিসপত্র ও টাকা-পয়সা কোম্পানি নিজের হেফাজতে নিয়ে নেয়।
এদিকে দিন, সপ্তাহ, মাস গুনতে গুনতে দেশে থাকা আমার পরিবার অনেক অসহায় হয়ে পড়ে। কেননা আমার ওপর নির্ভর করে চলতে থাকা সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। পরিবারের লোকজন জানে না কখন ফিরে আসব, আদৌ দেশে ফিরে আসতে পারব কি না? বিশেষ করে নিঃসন্তান আমার স্ত্রী আরাধন আক্তার হতাশায়, চিন্তায় অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। এর ফলে শারীরিকভাবে ভেঙে পরে আমার স্ত্রী। পরে শ্বশুর বাড়ির লোকজনই আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা করে।
এদিকে মামলা পরিচালনার জন্য কোনো টাকা-পয়সা না থাকায় পরিচিত মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে ও জায়গা বন্ধক রেখে টাকা পাঠানো হয়। ওই দেশে অন্য কোম্পানিতে চাকরি করত আমার দুই ভাই, কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা আইনজীবীর মাধ্যমে চেষ্টা করে আমাকে জামিনে বের করে আনার। কিন্তু বহিরাগতদের বিষয়ে মালিকের কোনো পদক্ষেপ না থাকলে ওই দেশের আদালত জামিন দেয় না। রায় পর্যন্ত কারাগারে অবস্থান করতে হয়। তাই রায় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা আমাকে করতে হয়।
অবশেষে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে রায়ে আমাকে খালাস দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগার থেকে বের হতে হলে কোম্পানির কাছে থাকা পাসপোর্ট ও পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। কোম্পানির কাছে পাসপোর্ট চাইলে তারা জানায়, পাসপোর্ট নিতে হলে স্ট্যাম্পে এই মর্মে লিখিত দিতে হবে যে, সকল পাওনা আমাকে পরিশোধ করা হয়েছে। এতে আমি আরো চিন্তায় পড়ে যাই। কারণ তারা আমার প্রাপ্য বাকি পাওনা দিতে অস্বীকৃতি জানায় কিন্তু আমাকে লিখিত দিতে বলে যে আমি সব পাওনা বুঝে পেয়েছি।
কোম্পানির নিয়মানুযায়ী ২১ বছর চাকরির মেয়াদ হওয়ায় আমার ভাতা পাওয়ার কথা। এ ছাড়া প্রায় দুই বছর ধরে আমার বেতন বকেয়া ছিল। সব মিলে প্রায় ৫০ হাজার দিরহাম পাওনা ছিল কোম্পানির কাছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে টাকার মায়া ছেড়ে দেশে ফিরে আসল বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অবশেষে কোম্পানির পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে লিখিত দিয়ে পাসপোর্ট কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিলাম। অবশেষে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফিরে আসি। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছর চাকরির পর কোনো টাকা পয়সা নিয়ে আসতে পারিনি। কাজেই হাত এখন একেবারেই শূন্য। বাড়িতে আমি এখন হতাশায় দিন কাটাচ্ছি।
আমি সরল বিশ্বাসে একটা লোককে বাসাভাড়া দিয়েছিলাম। কোম্পানি নিজের সুবিধার সময় আমাকে কাজে লাগিয়েছে, কিন্তু যখন বিপদে পড়লাম আমার পাশে তারা দাঁড়ায়নি। তার ওপর আমার পাওনা টাকাও তারা দেয়নি। তাই আজ আমি শেষ বয়সে এসে গরিব, অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছি। আমি এখন নিঃস্ব।’

জাকের হোসেন