শিল্পের জ্বালানি নিরাপত্তা : সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতির আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
শিল্পের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা ও সংরক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতি বা কর্মপরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা উল্লেখ করেছেন, ২০১৬ সালে একটি এনার্জি এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড কনজারভেশন মাস্টারপ্ল্যান এবং ২০২৩ সালে ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান করা হলেও, জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা নেই।
সোমবার (২৮ জুলাই) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শিল্পখাতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এই মন্তব্য করেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন বলেন, জ্বালানি-ভিত্তিক তথ্য প্রচার ও প্রাপ্তিতে একটি বড় শূন্যতা রয়েছে, যার ফলে এ বিষয়ক অনেক সরকারি সেবা সম্পর্কে বেসরকারি খাত অবগত নয়। এটি দূর করতে হবে। তিনি বেসরকারি খাতের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রমের অর্থায়নে তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এর মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং একটি টেকসই ব্যবসাবান্ধব জ্বালানি পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে সামগ্রিকভাবে অভ্যাসগত পরিবর্তন আনায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের বেসরকারি খাত যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে। সেই সঙ্গে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন জ্বালানি সরবরাহ না থাকার কারণে পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছি, ফলে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। তিনি শিল্প-কারখানায় নিয়মিতভাবে ‘এনার্জি অডিট’ বাস্তবায়নের ওপর জোরারোপ করেন এবং শিল্পের খাতভিত্তিক গবেষণায় শিক্ষাখাতকে সম্পৃক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় ‘ইন্ডাস্ট্রি ম্যাপিং’-এর আহ্বান জানান।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্বালানি দক্ষতার সংজ্ঞাগত ও ধারণাগত পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া দেশের জ্বালানি উৎস ও সরবরাহে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। তিনি বলেন, জ্বালানি দক্ষতার বিষয়ে গৃহীত পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে এবং শিল্পখাতে এ বিষয়ে কী ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে ও কতটা কার্যকর হয়েছে, তা অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। সেইসঙ্গে এখাতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও নিউ এইজ গ্রুপ-এর ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, দেশের বৃহৎ শিল্প-কারখানাসমূহে জ্বালানি সরবরাহ থাকলেও, বিশেষ করে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা জ্বালানি স্বল্পতার কারণে উৎপাদন কার্যক্রমে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়াও ঋণ প্রাপ্তি প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে তারা অর্থায়ন সমস্যায় মুখোমুখি হচ্ছেন, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। তিনি বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক হার হ্রাস করার প্রস্তাব দেন, যা শিল্পখাতে জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে। তিনি জানান, বর্তমানে প্রায় ২৫০টি তৈরি পোশাক খাতের কারখানায় সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে, যা এই খাতের শিল্পে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, জমি অধিগ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে পিপিপি মডেল অনুসরণের উপর তিনি গুরুত্ব দেন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মো. রফিকুল আলম বলেন, প্রতি কিউবিক এলএনজি আমদানিতে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা ব্যয় হলেও সরকার বিক্রি করছে ৩০ টাকায়। ফলে এখানে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সব স্তরের ভোক্তাদের জ্বালানি ব্যবহারের জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাঁচ থেকে ১৫ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব। সেইসঙ্গে এই খাতে গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি নবায়ানযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশিক্ষণ শাখা) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের মোট উৎপাদিত জ্বালানির ২৭ শতাংশ শিল্পখাতে ব্যবহৃত হয় এবং ২০৫০ সালে এ চাহিদা ৪০ শতাংশে উন্নীত হবে। তিনি বলেন, জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারে আমরা সাশ্রয়ী হলে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে শিল্প-কারখানাসহ জনগণকে জ্বালানি সেবা প্রদান সম্ভব হবে।
পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিপণন) মো. ইমাম উদ্দিন শেখ বলেন, প্রতিদিন আমাদের গ্যাসের চাহিদা তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও আমরা দুই হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি, ঘাটতি রয়েছে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ প্রাপ্তির লক্ষ্যে শিল্পাঞ্চলসমূহে কারখানা স্থাপনের জন্য তিনি উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
আলোচনায় ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মো. সালিম সোলায়মান এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)