ইসির সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো যা বলল
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন সংলাপের আয়োজন করেছে। সেখানে ১২ দল তাদের মতামত তুলে ধরেছে। সকাল ও বিকেল দুই দফার সংলাপে ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নানা মতামত তুলে ধরে। রাজনৈতিক নেতাদের এসব মতামত শুনেছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এ মতামত থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।
সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) ডক্টর চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বীর বিক্রম বলেন, আমরা মনে করি এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট নিরাপত্তা সংকট বিরাজ করছে। শুধু প্রত্যন্ত অঞ্চলে নয়, বাংলাদেশের শহর, বন্দর ও নগরীতে। কোনো কোনো দল তাদের কর্তৃত্ব ও বর্তমান অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য ডাকাত থেকে শুরু করে তাদের চিহ্নিত সন্ত্রাসী পর্যন্ত ব্যবহার করছেন। আমরা নির্বাচন সঠিক সময়ে চাই। তবে ভোটারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই তফসিল ঘোষণার পূর্বেই একটা নিরাপত্তা সিকিউরিটি অপারেশন করা উচিত।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মওলানা ইউসুফ সাদেক হাক্কানী বলেন, অতীতের নির্বাচনে দেখা গেছে, কালো টাকার প্রভাব বিস্তার ও হুমকি-ধমকির মাধ্যমে ভোটারদেরকে প্রভাবিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যদি এগুলোর প্রতি সুদৃষ্টি রাখা হয় এবং আগে থেকেই এগুলোকে প্রতিহত করার জন্য এখান থেকে প্রোগ্রাম করা হয় তাহলে আমাদের দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা পেয়ে যাব। আর যারা দেশের শত্রু তাঁরা যাতে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেজন্য আপনাদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মহিউদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক দলের একটা শর্ত নির্বাচন অফিসে আছে সেটা হচ্ছে ৩৩ ভাগ মহিলা সদস্য বাধ্যতামূলক। আমরা আগেও দাবি জানিয়েছি আজকেও দাবি জানাচ্ছি, এটা বিশেষ করে ইসলামী দলগুলোর জন্য কঠিন হয়ে যায়। ৩৩ শতাংশ মহিলা সদস্য কমিটিতে রাখা এই বিষয়টি আপনারা বিবেচনা রাখবেন।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের উপদেষ্টা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবু বলেন, আমরা সঠিক সময় নির্বাচন চাই ও নির্বাচনের পরিবেশ যাতে উন্নত হয় সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের যথাসাধ্য চেষ্টা থাকতে হবে।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ সালাউদ্দিন সালু বলেন, জামানতের টাকা ৫০ হাজার করা হয়েছে এটা বুর্জোয়া দলগুলোর পক্ষে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের মতো দলের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগে যে ২০ হাজার টাকা ছিল আমি দাবি করবো জামানত সেই ২০ হাজার টাকাই যেন রাখা হয়।
বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, বড় দলগুলো নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখনও বিশাল বিশাল মহড়া চলছে। ইসি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, কোনো কমিশনই বলে না তারা নিরপেক্ষতা হারাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে তারা আর নিরপেক্ষ থাকে না। এটা আমাদের অতীত ইতিহাস। তবে এই কমিশনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে নতুন ইতিহাস তৈরি করবেন এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মতো আরেকটা নির্বাচন চাপিয়ে দিলে তা কমিশনের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, আমরা আপনাদের প্রকাশিত গেজেট অনলাইনে সংগ্রহ করেছি পরশুদিন, যেখানে আরপিও বা Representation of the People Order 1972 অনুযায়ী কিছু বিষয় উল্লেখ আছে। সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি উল্লেখ করতে চাই—আমরা যারা নির্বাচন করি, রাষ্ট্র, সরকার কিংবা আপনারা সবাই—আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গরীব, মেহনতি ও পরিশ্রমী। আমরা ভোটের সময় তাদের কাছেই যাই, তাদের ভোট চাই। কিন্তু তারা নিজেরা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, প্রার্থী হতে পারে—এই বিষয়টি আমরা প্রায়ই বিবেচনায় আনি না।
যদি সত্যিই আমরা তা ভাবতাম, তাহলে জামানতের টাকা ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করতাম না। আমাদের দলের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো— জামানতের পরিমাণ ৫০০ টাকা করা উচিত। গরীব ও মেহনতি মানুষের ভোট নেবেন, কিন্তু তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখবেন না—এটা তো বৈষম্য। আমরা জানি, আমাদের দেশে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ এখন বৈষম্য আরও গভীর হয়েছে—যার টাকা আছে, সে-ই নির্বাচন করতে পারছে। একজন সাধারণ মানুষ, একজন সম্মানিত স্কুলশিক্ষক, যার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আছে—তিনি প্রার্থী হতে পারছেন না। অর্থাৎ আমরা পরোক্ষভাবে ধনী, লুটপাটকারী ও অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্যই সুযোগ তৈরি করছি। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আমি আশা করি আপনারা তা গভীরভাবে বিবেচনা করবেন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, ইতোমধ্যে অনেকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করারও পাঁয়তারা করে চলেছে। আমরা মনে করি—অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলসমূহের সদিচ্ছা। এ ছাড়া টাকা শক্তি, পেশিশক্তি, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও প্রশাসনিক কারসাজি মুক্ত নির্বাচনি পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সকলের ভোট দেওয়া ও প্রার্থী হওয়ার সমান অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এগুলো নিয়ে আলোচনা, মতামত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কী হয়েছে—তা এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।
বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি যে এবারও আরপিওর যে সংশোধন করা হয়েছে, সেখানে নাগরিকরা শুধু ভোট দিতে পারবে কিন্তু প্রার্থী হতে পারবে না। এরকম আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা হয়েছে। যেমন জামানতের টাকা ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। নির্বাচনি ব্যয়সীমা ভোটার প্রতি ১০ টাকা করে অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদকে অতীতের মতোই কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত করবে। আরপিওতে না ভোট এর বিধান শুধুমাত্র একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনো ভোটারের যদি তিনজন বা পাঁচজন প্রার্থীর কাউকেই পছন্দ না হয়, তাহলে কি সে মন্দের ভালো বেছে নেবে? তাই না ভোট এর বিধান সব আসনেই রাখার দাবি আমরা করছি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জিএসডি) সিনিয়র সহ-সভাপতি তানিয়া রব বলেন, আমার নিজস্ব নির্বাচনি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি— মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও অনেক সময় সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। কোনো সমস্যা বা দুর্ঘটনা ঘটলে বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেটকে বলুন বা অমুক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন—কিন্তু তখন মাঠপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে প্রার্থী ও ভোটার উভয়েই ভোগেন মারাত্মক হয়রানিতে। প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে প্রিজাইডিং অফিসাররা স্থানীয় এলাকায় নিজেদের আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের মধ্যে থাকেন। এতে নিরপেক্ষতার ঘাটতি দেখা দেয়। যদি অন্তত পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ করা যায়, তাহলে একটি পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনেক বেশি সম্ভাব্য হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আপনাদের (ইসি) ওপরে বহু ধরনের চাপ ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করেছি—কিছু যৌক্তিক, কিছু অযৌক্তিক। ভবিষ্যতে এই চাপ আরও বাড়বে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনাদের পেশাগত ও সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের প্রতি, ভোটারদের প্রতি। তাই আশা রাখি, কোনো অযৌক্তিক চাপের কাছে আপনারা নতি স্বীকার করবেন না। দৃঢ়চিত্ত, বলিষ্ঠ ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে আমরা দেখতে চাই।

নিজস্ব প্রতিবেদক