পরিচয় দেওয়ার পরও গুলি করে পুলিশ, লুটিয়ে পড়েন ফটোসাংবাদিক তোরাব
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় করা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) তিনজন সাংবাদিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ নিয়ে এ মামলায় মোট ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হলো।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সাংবাদিক মোহিদ হোসেন বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) দেশব্যপী বিএনপির গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ছিল। পুলিশ বাধা দিচ্ছিল। হাত উঁচিয়ে পরিচিত পুলিশকে লক্ষ্য করে বলছিলাম—দস্তগীর ভাই (এডিসি) আমরা সাংবাদিক, আমাদেরকে গুলি কইরেন না। তারপরও পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে আমার সহকর্মী দৈনিক জালালাবাদ এবং দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আবু তোরাব গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তাকে আমি রিকশায় এবং পরবর্তীতে সিএনজিতে (অটোরিকশা) করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই, সেখানে তিনি মারা যান।’
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এ আজ সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন।
সাক্ষী মো. মোহিদ হোসেন বলেন, “আমি সিলেটের দৈনিক ‘৭১ এর কথা’ এর ফটো সাংবাদিক। ১৯-০৭-২০২৪ তারিখ (শুক্রবার) দেশব্যপী বিএনপির গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ছিল। তারই অংশ হিসেবে সিলেটের মধুবন পয়েন্টের নিকটে অবস্থিত কালেক্টরেট জামে মসজিদে জুম্মার নামাজের পর একটি গায়েবানা জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমি সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাই। ১৯ জুলাইয়ের আগে আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছে, তাদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং জানাজা শেষে একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি জিন্দাবাজারের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ পেছন দিক থেকে অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে।’
‘আমি ও আমার সহকর্মী সাংবাদিক আবু তোরাব পেশাগত দায়িত্বপালন করছিলাম। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। আমি হাত উঁচিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বলছিলাম, দস্তগীর ভাই (এডিসি) আমরা সাংবাদিক, আমাদেরকে গুলি কইরেন না। তারপরও পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে আমার সহকর্মী দৈনিক জালালাবাদ ও দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আবু তোরাব গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তাকে আমি রিকশায় এবং পরবর্তীতে সিএনজিতে (অটোরিকশা) করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন চিকিৎসায় বাধা দেওয়ায় তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ঐ দিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে সে মারা যায়’, যোগ করেন সাক্ষী মোহিদ হোসেন।
জবানবন্দিতে মোহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘পুলিশের এডিসি সাদিক কাউসার দস্তগীর, কোতয়ালী থানার এসি মিজানুর রহমান, কোতয়ালী থানার ওসি মহিউদ্দিন অনেকে গুলিবর্ষণ করে। উক্ত ঘটনার একটি ভিডিও সংগ্রহ করেছি। উক্ত ভিডিও সম্বলিত একটি পেনড্রাইভ অদ্য ট্রাইব্যুনালে দাখিল করলাম। এই সেই পেনড্রাইভ (বস্তু প্রদর্শনী-XVIII)।’ এরপর ভিডিওটি অদ্য ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। ভিডিওটিতে বিক্ষোভ মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের দৃশ্য এবং গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক আবু তোরাবকে মাটিতে বসে থাকতে এবং পরবর্তীতে তাকে এই সাক্ষী কর্তৃক রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
সাক্ষী মোহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে জবানবন্দি দেওয়ার পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আল জাজিরা, বিবিসির ডকুমেন্টারির মাধ্যমে জানতে পারি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে। পরবর্তীতে আরও জানতে পারি এ ঘটনার জন্য আরও দায়ী তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের প্রধান, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ আরও অনেকে।’ এ গুলিবর্ষণের ঘটনায় দোষীদের এবং নির্দেশদাতাদের বিচার চান তিনি।
এছাড়া আজ ৩১নং সাক্ষী হুমায়ুন কবির লিটন এবং ৩২নং সাক্ষী ডা. মোহাম্মদ হাসানাৎ আল মতিন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া অভিযোগগুলো হলো—
প্রথম অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ
জুলাই- আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ
১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।

 
                   জাকের হোসেন
                                                  জাকের হোসেন
               
 
 
 
