হত্যার অভিযোগ দীপ্তের বাবা-মায়ের, শোকে বিহ্বল পরিবার
 
দরজার বাইরে থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। দরজা খুলে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকতেই কয়েকজন বন্ধু দেখলেন, রেজিনা সুলতানা ছেলে আরিয়ান আলম দীপ্তের মৃত্যু শোকে বিলাপ করছেন, কাঁদছেন। চোখ তাঁর লাল টকটকে আকার ধারণ করেছে।
এ দৃশ্য দেখে বান্ধবী রেজিনাকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়া বন্ধুরা যখন কেঁদে ফেললেন, তখন পরিবেশ আরও ভারী হয়ে ওঠে। সবার চোখ-মুখ তখন ছলছল! রেজিনার বিলাপ আরও বেড়ে যায়। পরিবেশটা এমন, যেন আর কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার নেই!
গতকাল শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর নাখালপাড়ার আরিয়ান দীপ্তের বাসায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। পরিবারের লোকজন, দম্পত্তির বন্ধু-বান্ধবসহ বাসায় আরও আত্মীয়-স্বজন ছিল। সবার চোখ-মুখে ছিল যাতনা আর বিয়োগের গল্প! সবার দীর্ঘশ্বাসে ঝরছিল দীপ্তের স্বপ্ন! দীপ্ত চাটার্ড অ্যাকাউট্যান্ট হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেন। হতে চাইতেন ব্যবসায়ীও।
গত সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) কানাডার টরন্টোয় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর একজন আরিয়ান দীপ্ত। রেজিনা সুলতানা ও এটিএম আলমগীর দম্পত্তির ছোট ছেলে দীপ্ত। লেখাপড়া করতেন কানাডার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। রেজিনা যখন বিলাপ করছিলেন, তখন আক্ষেপ করে আলমগীরও তাঁর সন্তান শোক মুখে ফোটাচ্ছিলেন। দীপ্তের ছবি দেখিয়ে তাঁর বন্ধুদের নানা ঘটনা জানাচ্ছিলেন।
বন্ধুদের সঙ্গে কথার এক ফাঁকে আলমগীর বলছিলেন, ‘বুকটা আমার ফেটে যাচ্ছে। আমার যে আর কেউ নেই! কীভাবে থাকব আমরা? এতোদিন শুনিনি, আজ দুবাইতে থাকা দীপ্তের বন্ধু ফয়সালের কাছ থেকে অনেক ঘটনা শুনলাম। ঘটনার দিন আরিয়ানের অনিচ্ছার শর্তেও জোর করে বাসা থেকে কেন নিয়ে যাওয়া হলো। এর পেছনে কী কোনো কারণ থাকতে পারে, এটা জানার দরকার।’
 
রেজিনা সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। তাঁকে সান্ত্বনা ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন তাঁর কয়েকজন বন্ধু। বন্ধুদের সঙ্গে বিলাপ করতে করতে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রেজিনা সুলতানা বলছিলেন, ‘ওরে আমার আব্বা রে, আমি কোথায় পাই রে। ও আমার দীপ্ত রে। ১১ ফেব্রুয়ারি আমার ছেলের জন্মদিন ছিল। ও মারা যাওয়ার ১০ ঘণ্টা পরে শুনছি মারা গেছে। এর মধ্যে আমি ছেলেকে ম্যাসেজ দিছি। আমি বলি, কি রে; ও আমাকে রিপ্লাই দেয় না ক্যান?’
রেজিনা সুলতানা আর বলেন, ‘সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ-এর ছেলে নিবিড় কুমার এবং আমার ছেলে দীপ্ত একসঙ্গে এক বাসায় অনেকদিন ছিল। ওখানে কী হয়েছে, তা আমাকে বলেনি। শুধু বলেছিল, সে আর থাকতে পারবে না ওখানে। ওরা (দীপ্ত, কুমারসহ তাঁদের বন্ধুরা) ৩১ ডিসেম্বর একটি পার্টিতে যায়। সেখানে তাদের এক মেয়ে বন্ধুও ছিল। তাদের মধ্যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে আর্গুমেন্ট হয়েছিল। পুলিশও এসেছিল।’
রেজিনা সুলতানা আর বলেন, ‘যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে, সেদিন কুমারসহ অন্যরা আমার ছেলেকে ওর বাসা থেকে আনতে যায়। আমার ছেলে যেতে চায়নি। এসব ঘটনা তার দুবাইয়ের বন্ধুকে জানিয়েছিল আমার ছেলে। ওই বন্ধু বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে। সেসব কথার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এসব ঘটনা কেন ঘটল? তদন্ত করা হোক। আমি বিচার চাই।’
 
এ টি এম আলমগীর আজ শনিবার বিকেলে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কানাডায় মারা যাওয়া শাহরিয়ার খানের বাবা শরীফ খানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা এ ঘটনায় নিবিড় কুমারের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একই ঘটনায় নিহত অ্যাঞ্জেলা বারৈর বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। আমরা আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে যে প্রক্রিয়াতে মামলা করার সুযোগ থাকে, আমরা মামলা করব।’
এ টি এম আলমগীর জানান, আগামী সোমবার স্থানীয় একটি মসজিদে দীপ্তের জানাজা হবে। বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের উদ্দেশে মরদেহ পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে শুনেছি আমরা। কোনো কারণে এর আগে-পরেও আসতে পারে।
কানাডার টরন্টোয় গত সোমবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী নিহত হন। গুরুতর আহত হন নিবিড় কুমার। তিনি টরন্টোর সেন্ট মাইকেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। দেশটির ডান্ডাস স্ট্রিট ওয়েস্টের ৪২৭ নম্বর মহাসড়কের দক্ষিণমুখী র্যাম্পে সড়ক দুর্ঘটনায় ওই তিন শিক্ষার্থী নিহত হন।

 
                   মাসুদ রায়হান পলাশ
                                                  মাসুদ রায়হান পলাশ
               
 
 
 
