স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : তারেক রহমানের সামনে যত চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
দীর্ঘ ১৭ বছরের ত্যাগ-তিতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটে দেশের মাটিতে পা রাখবেন তিনি। দেশের আপামর জনগণ তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়তে তারেক রহমানের প্রতি আস্থা রাখতে চান দেশের মানুষ। তবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তারেক রহমান নিজেকে কতটা তৈরি করতে পেরেছেন?
রাজনৈতিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, দেশের টালমাটাল অবস্থা এবং ফেব্রুয়ারিতে একইদিনে নির্বাচন ও গণভোট— এ রকম ক্রান্তিকালে বিএনপিকে আগামীতে সংসদে নিয়ে যাওয়া তারেক রহমানের দায়িত্বের বড় একটা অংশ। আবার রাজনীতির বিভক্তি, বিভাজন, হিংসা— এই পরিস্থিতিতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করাও একটা চ্যালেঞ্জ। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট রেজিম ও তাদের বিচার প্রক্রিয়া এবং সংস্কার— এটা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ এবং দায়িত্ব নিয়ে তারেক রহমান ফিরছেন।
তবে তারা মনে করেন, তারেক রহমান প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে, তিনি যে জায়গায় আছেন বাংলাদেশে এমন তাৎপর্যপূর্ণ জায়গায় আর কোনো ব্যক্তি নেই, তার জন্য বিশাল সম্ভাবনা আছে। এখানে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে শুধু তার দল নয়, পুরো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। আমরা ইতিবাচকভাবেই চিন্তা করব। তার প্রজ্ঞা, চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতাকে তিনি কাজে লাগাবেন।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবারে তারেক রহমানের জন্ম। তার বাবা-মা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক উত্তরণে তাদের দুজনের ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। সেই পরিবারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা— এটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিকভাবেই এক ধরনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, চিন্তার দিক থেকে, আইডিয়ার দিক থেকে, মেধার দিক থেকে— এক ধরনের ইনহেরেন্ট জায়গা থেকে হয়েছে।
জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ১/১১ সময় নির্যাতিত হওয়া তারেক রহমান, চিকিৎসার জন্য তার বাইরে যাওয়া। ১৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরছেন— নতুন মানুষ হয়ে ফিরছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ বছর খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন থাকলেও তারেক রহমানই মূলত দলটাকে সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। দলকে পরিচালনা করেছেন। সেখানে তিনি নিশ্চয়ই যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। যে কারণে ইতোমধ্যে বৃহৎ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে বিএনপি।
তিনি বলেন, একটা পারিবারিক বিপর্যয় (কোকোর মৃত্যু) ছিল, বিএনপির ওপর নির্যতন, হত্যা, খুন , গুম, জুলুম, লক্ষ লক্ষ মামলা। কঠিন সময়ে এসব মোকাবিলা করে দলকে গত ১৭ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছেন তিনি।
সাইফুল হক আরও বলেন, ইতোমধ্যে তারেক রহমান দেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছেন, চিন্তা করেছেন— এখন তিনি সশরীরে নেতৃত্ব দেওয়ায় তার ভাবনাগুলো বাস্তবায়নে সামনে চ্যালেঞ্জ থাকবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের ভিশন, চিন্তা, স্বপ্ন, পথরেখা এখন বাস্তবে এসে প্রমাণ করার বিষয়। ভার্চুয়ালি নেতৃত্ব আর বাস্তবে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে বেশ খানিকটা পার্থক্য আছে। তাকে নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করার বিষয় রয়েছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, দেশে এখন টালমাটাল এক অবস্থা— ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন এবং গণভোট একসাথে। এ রকম ক্রান্তিকালে বিএনপিকে আগামীতে সংসদে নিয়ে যাওয়া তার দায়িত্বের বড় একটা অংশ। আবার আমাদের রাজনীতিতে যে বিভক্তি, বিভাজন, হিংসা— এই পরিস্থিতিতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। এটা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এমন একটি বিভক্তি-বিভাজনের রাজনৈতিক পরিবেশে সবার সাথে ওয়ার্কিং রিলেশন বিল্ডআপ করাও একটা চ্যালেঞ্জ।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব
বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বেশিরভাগই অনেক সিনিয়র। তাদের তুলনায় বয়সের দিক থেকে তারেক রহমান অনেক জুনিয়র। একজন জুনিয়র ব্যক্তি এত প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছেন— এটা তার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রবীণ নেতাদেরকে নিয়ে একটা টিম হিসেবে কাজ করতে পারা— এক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। দলটির ওপর থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত অর্গানিক রিলেশনশিপ। নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে নেতৃত্বে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সাইফুল হক বলেন, তারেক রহমান যোগ্যতা দিয়েই জীবন্ত সম্পর্ক তৈরি এবং নানা বাধা মোকাবিলা করে এই জায়গাটাতে আসতে পেরেছেন।
ভার্চুয়ালি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার নজির পৃথিবীতে নেই
২০১৮ সালে বিএনপির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের হাল ধরেন। দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। তখন থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভা, দলের গুরুত্বপূর্ণ সভায় ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করে আসছেন। নিয়মিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করে থাকেন। এছাড়া নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
সারাদেশে বিএনপির ৩১ দফা নিয়ে আলোচনাগুলোতে অংশ নিয়ে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
সাইফুল হক বলেন, এতদিন দেশের বাইরে থেকে ভার্চুয়ালি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এত বড় একটা দলকে এভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার নজির পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আগে তো এমন সুযোগও ছিল না। ইন্টারনেটের কল্যাণে এই সুযোগটা হয়েছে।
দল এবং দেশকে নেতৃত্বে দেওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ
দল এবং দেশকে নেতৃত্বে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে তারেক রহমানের সামনে।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এখনও বিএনপির কালেক্টিভ জায়গাটা ডেভলাপ করেনি। এত পজেটিভের মধ্যে এটা কিন্তু...। দলের যৌথ নেতৃত্বের যে বিষয়টা এখানে, গঠনতান্ত্রিক দিক থেকে চেয়ারপারসনের সীমাহীন ক্ষমতা। মডার্ন ডেমোক্রেটিক সিস্টেমে পৃথিবীর অনেক দেশেই একজন ব্যক্তির এত ক্ষমতা থাকে না। এটার সঠিক প্রয়োগ হলে ভালো, যদি না হয় তাহলে কিন্তু পুরো দলটা কলাপস করে বিপর্যয়ের মুখ পড়ে। এই জায়াগাটাতে তিনি ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
সবকিছুই এখন তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে— এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর যেমন সুবিধা আছে, তেমনি ভবিষ্যতে বিপজ্জনক জায়গাও আছে। ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের প্রশ্ন। কোনো ব্যক্তি যত যোগ্যই হউক, তিনি ভুল করতে পারেন। পৃথিবীর চৌকস ব্যক্তিদের অনেকেই অনেক ভুল করেছেন। যৌথ নেতৃত্ব থাকলে ভুলের সংখ্যাটা কম থাকে। মানুষ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ভুল করার ঝুঁকিটা বেশি থাকে। এটাই হয়তো বিএনপির ডেমোক্রেটিক ট্রানজেশনাল পিরিয়ড। বিএনপি যদি বিষয়টি বিবেচনায় রাখে তাহলে সময়ের প্রয়োজনে, হয়তো ভ্যাকুয়াম পূরণ হয়ে যাবে।

মাহমুদুল হাসান