‘হঠাৎ ইউটার্ন কেন?’ জবাবে ফজলুর রহমান ‘৭৮ বছরে এ রকম কখনো বলিনি’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করায় আদালত অবমাননার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের তলবে হাজির বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসন থেকে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান শুনানির এক পর্যায়ে বলেন, মাই লর্ড আল্লাহর পরই আপনাদের প্রতি আমার সম্মান। আমার বয়স ৭৮ বছর। এরকম কথা জীবনে কখনো বলিনি। জবাবে আদালত বললেন, ‘গত ১৫ বছর দেখেছি, আপনি কত অন্যায় আর অবিচারের শিকার। হঠাৎ কেন এমন ইউটার্ন?’
আজ সোমবার (৮ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে শুনানিকালে এসব কথা বলেন ফজলুর রহমান। বেলা ১১টার দিকে দুই সিনিয়র আইনজীবীসহ প্রায় ২০ জনের এক প্যানেল আইনজীবী নিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রবেশ করেন। পরে ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক এজলাসে বেলা ১১.৪০ মিনিটে বসেন। শুরুতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন বলেন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল শুনানি করবেন।
পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল দাঁড়িয়ে বলেন, ফজলুর রহমান সিনিয়র আইনজীবী, পলিটিশিয়ান ও মুক্তিযোদ্ধা। তার বক্তব্যের বিষয়ে আমরা লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছি। ফজলুর রহমান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, পরে আদালত তাকে বসতে অনুমতি দেন।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রসিকিউশন আগে বলুক। এরপর প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, চ্যানেল ২৪-এর মুক্তবাক অনুষ্ঠানে ফজলুর রহমান বলেছেন, ‘‘আমি প্রথম দিন থেকেই বলছি, এই কোর্ট আমি মানি না। প্রতিদিন বলছি এই কোর্ট আমি মানি না।’’
ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা একটু ফজলুর রহমানকে শুনতে চাই। ফজলুর রহমান দাঁড়ালে ট্রাইব্যুনাল তার কাছে জানতে চান তিনি এসব কথা বলেছেন কি না? যদি তিনি বলেন, এভাবে বলতে চাননি। তাহলে এক রকম। আর যদি বলেন, তিনি বলেছেন এবং আরও বলবেন; তাহলে আরেক ধরনের বিবেচনা।’
ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘ফজলুর রহমান আপনি কাইন্ডলি বলবেন, আপনি এই কথা বলেছেন কিনা।’
তখন ফজলুর রহমান বলেন, ‘মাই লর্ড, আমি এইভাবে বলি নাই।’ এ সময় ব্যারিস্টার কাজল বলেন, আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমরা ওনার কাছ থেকে শুনি। উনি যদি বলেন, ‘এগুলো বলিনি একভাবে কনসিডার করবো, আর যদি বলেন বলেছি, আরও বলবো তাহলে অন্যভাবে কনসিডার (বিবেচনা) করবো।’
জবাবে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাচ্ছি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওনাকে তো আমরা চিনি। তিনি সিনিয়ির পলিটিক্যাল লিডার, সিনিয়র আইনজীবী। কথা হলো তিনি আরও বলবেন কি না? তিনি যা বলেছেন, তা শুধু বাংলাদেশ না সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। তিনি এসব বললে মানুষ কি মনে করবে?’
ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘এখানে শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অপরাধেরই বিচার হবে না, আইনে বলা আছে আইন হবার আগে-পরে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে।’
জবাবে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালের বিচার সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। তাই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।’
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারক গোলাম মূর্তজা মজুমদার বলেন, বাইরে আলোচনা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আরে আমরাও তো মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছি। আমার পরিবারে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছি,কোন ব্রিজ ভাঙতে হবে দেখিয়ে দিয়েছি, সহযোগিতা করেছি- আমরা মুক্তিযোদ্ধা না, যারা লন্ডনে ছিল তারা মুক্তিযোদ্ধা? কিন্তু আমরা কখনো এগুলো বলি না। এ দেশে কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করে না। তাই কথা কথায় মুক্তিযোদ্ধাদের টানবেন না। একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ফ্যামিলিতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। রাতে রুম ছেড়ে দিয়েছি। রাতে খাইয়েছি। কোন ব্রিজ ভাঙতে হবে, বলে দিয়েছি। আপনাদের (মুক্তিযোদ্ধা) অবস্থান সুপিরিয়র। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে সহজে আনবেন না। জুডিশিয়ারিকে আপনারা গাইড করবেন।’
ট্রাইব্যুনালের অপর বিচারক শফিউল আলম মুহিত ফজলুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, গত ১৫ বছর দেখেছি, আপনি কত অন্যায় আর অবিচারের শিকার। হঠাৎ কেন এমন ইউটার্ন?
জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, আমি আপনাদের এত সম্মান করি, আল্লাহর পরই আপনাদের প্রতি আমার সম্মান। আমার বয়স ৭৮ বছর। এরকম কথা জীবনে কখনো বলিনি।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমরা আশা করি আপনারা জুডিশিয়ারিকে গাইড করবেন। ভাল-মন্দ দেখবেন। সরকারকে বলবেন, চিফ জাস্টিসকে বলবেন। যেখানে বলা দরকার সেখানে বলবেন।
তখন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ট্রাইব্যুনালের ওপর ফজলুর রহমানের পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এ ধরনের মন্তব্যের জন্য তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চান। তিনি সত্যিই এ ঘটনার জন্য অনুতপ্ত।
এ সময় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ফজলুর রহমান কোর্টকে ম্যালাইন করার জন্য এ রকমের কথা বলবেন, এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন। জুডিশিয়ারি যদি ফাংশন না করে, তাহলে তো দেশ বর্বর হয়ে যাবে।
এ সময় সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, টকশোতে গেলে যা বলতে চাই না, অনেক সময় তাও মুখ থেকে বের করে ফেলে। এখন সিনিয়র আইনজীবী বলেন আর মুক্তিযোদ্ধা বলেন- এখন আর সমাজে সম্মানটা পাওয়া যায় না। ফজলুর রহমান এরকম কথা বলবেন, তা কি বিশ্বাসযোগ্য? আদালত সবার উপরে। বিচার বিভাগ না থাকলে রাষ্ট্র বরবাদ হয়ে যাবে। তারপরও তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছেন। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন। পরে ফজলুর রহমানের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, অল দ্য বেস্ট। আরও অনেকদিন বেঁচে থাকেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক