জুলাই হত্যাকাণ্ডের প্রথম রায়, ৩৯৭ দিনের পরিক্রমা
গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঘোষণা হতে যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম, যার রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ঘোষণা করা হবে।
টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে রায় ঘোষণার কার্যক্রম। বিচারপতি গোলাম মো. মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন— বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আজ বেলা ১১টায় রায় ঘোষণা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। অন্যদিকে রাষ্ট্রনিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট আমির হোসেন।
প্রথম রায়ের ৩৯৭ দিনের পরিক্রমা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এই মামলার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) করা হয় এবং একই দিনে ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
মামলার টাইমলাইন—
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ : শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।
১৬ মার্চ, ২০২৫ : সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১২ মে, ২০২৫ : তদন্ত প্রতিবেদন চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নাম যুক্ত হওয়ায় মোট আসামি হয় তিনজন।
১ জুন, ২০২৫ : প্রসিকিউশন তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে।
১০ জুলাই, ২০২৫ : আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন। সেদিনই সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ মামুন রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন।
৩ আগস্ট, ২০২৫ : চিফ প্রসিকিউটর সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণের জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
৮ অক্টোবর, ২০২৫ : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষ হয়।
১২ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ : যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়।
১৭ নভেম্বর, ২০২৫ : রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করা হয়।
‘মিসকেস’ হিসেবে মামলা দায়ের থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত এই মামলার মোট সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে এই মামলার প্রধান আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর অন্য দুই আসামি হলেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিন আসামির মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক অবস্থায় ভারতে অবস্থান করছেন।
জুলাই হত্যাকাণ্ড: ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় আজ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে ৫ অভিযোগজুলাই হত্যাকাণ্ড: ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় আজ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে ৫ অভিযোগ
মামলায় গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘রাজসাক্ষী’ বা ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জানান, গত বছরের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ পেয়েছিলেন।
৫টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, রাষ্ট্রপক্ষের মৃত্যুদণ্ড দাবি
মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) একাধিকবার দাবি করেছে, শেখ হাসিনা ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধের মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরীহ, নিরস্ত্র দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ৩০ হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছিল।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় রাষ্ট্রপক্ষ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শহীদ পরিবার ও আহত আন্দোলনকারীদের মধ্যে হস্তান্তর করার আবেদন জানিয়েছে।
বিদেশি গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের বক্তব্য অগ্রাহ্য
বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন— এ বিষয়ে প্রসিকিউটর বলেন, ট্রাইব্যুনালে হাজির না হয়ে তিনি যেসব কথা বলছেন, তা আইনের দৃষ্টিতে কোনো বক্তব্য নয়। শেখ হাসিনার ভয়েস রেকর্ড উন্মুক্ত আদালতে বাজিয়ে শোনানো হয়েছে, যেখানে কথোপকথনের মাধ্যমে তিনি নিজ মুখে মারণাস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন বলে শোনা গেছে। ভারতের মাটিতে বসে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্যকে প্রসিকিউশন আমলে নিচ্ছে না, এটিকে সরকার ও কূটনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আদালত অবমাননার দায়ে ৬ মাসের সাজা
‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’— শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের অডিও রেকর্ড বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করে আদালত অবমাননার মামলা করে প্রসিকিউশন। চলতি বছরের ২ জুলাই এই মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিন মামলা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মামলা ছাড়াও মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও তিনটি মামলা চলমান—
হেফাজতে ইসলামের মামলা (২০১৩) : রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় ২১ জনকে আসামি করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে।
গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধে ২ মামলা : আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলে সংগঠিত গুমের ঘটনায় করা এই ২ মামলায় শেখ হাসিনাসহ মোট ২৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এই ২ মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর হওয়ার কথা রয়েছে।
ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিশে’র প্রস্তুতি
প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার জানান, এ মামলায় ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে শাস্তি দিলে ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে আরেকটি ‘কনভিকশন ওয়ারেন্টের’ আবেদন করা হবে, যাতে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা যায়।

নিজস্ব প্রতিবেদক