আদালতে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ ছিল : শেখ হাসিনার আইনজীবী
রাষ্ট্রনিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেছেন, প্রসিকিউশন আমাকে তথ্যাদি সরবরাহ করেছে। কোর্টে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের সব পরিবেশ ছিল। আমি আশা করি আসামিরা খালাস পাবে। আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের রায়ের দিন ধার্য হওয়ার পরে এই কথা বলেন তিনি।
এর আগে বেলা ১২ টা ৫ মিনিটে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার রায়ের দিন আগামী ১৭ নভেম্বর ধার্য করেন।
এদিন আদালত বসার শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতকে বলেন, ‘মাইলর্ড আজকে মামলাটি রায়ের দিন নির্ধারণে দিন ধার্য আছে।’ পরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান গোলাম মর্তূজা মজুমদার রায়ের দিন আগামী ১৭ নভেম্বর (সোমবার) দিন ধার্য করেন। এ সময় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
এদিন রায়ের দিন ধার্য নিয়ে দেশি-বিদেশি অসংখ্যা মিডিয়াকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের দিন নির্ধারণের পরে চিফ প্রসিকিউটর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলার বিচার নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টির সুযোগ নেই। লাইভ কভার হয়েছে। দেশ বিদেশে ওপেন বিচার হয়েছে। আমরা তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। আমি আশা করি আসামিদের সর্বোচ্চ দণ্ড হবে।’
অপরদিকে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘প্রসিকিউশন আমাকে তথ্যাদি সরবরাহ করেছে। কোর্টে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের সব পরিবেশ ছিল। আমি আশা করি আসামিরা খালাস পাবেন।’
এর আগে এ রায়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। গত কয়েকদিনে সারাদেশে গাড়িতে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপি প্রতিরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রায়কে কেন্দ্র কঠোর অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যারা সারাদেশে নাশকতা করছে তাদের বিষয়টি প্রশাসন দেখবে। এ নিয়ে প্রসিকিউশন কোনো প্রকার ভীত নয়।’
গত ২৩ অক্টোবর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে রায়ের দিন নির্ধারণের জন্য ১৩ নভেম্বর ধার্যের আদেশ দেন। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল ও চিফ প্রসিকউটরের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের দিন নির্ধারণের তারিখ ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম ও মিজানুল ইসলাম। শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। গত ১০ জুলাই এ মামলার রাজসাক্ষী হন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
গত ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসামি করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনেন। অভিযোগগুলো হলো—
প্রথম : গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয় : হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয় : রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চতুর্থ : রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম : শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই প্রথম কোনো মামলা, যেখানে শেখ হাসিনার কারাদণ্ড হয়েছে।
এ রায়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে উত্তপ্ত পরিবেশ। গত কয়েকদিনে সারা দেশে গাড়িতে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপি প্রতিরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রায়কে কেন্দ্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা।

নিজস্ব প্রতিবেদক