ভাইকে ছুরিকাঘাতের পর কাদায় চুবিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন তারা
 
মাছ ধরার জন্য বোয়ালিয়ার নৌখালে ডাল-পালা দিয়েছিলেন আবুল হোসেন। সে অনুযায়ী শনিবার সকালে সেজো ভাই মোশাররফ হোসেনকে মাছ ধরতে নৌখালে নামেন আবুল হোসেন। কিন্তু সরকারি খাল হলেও মাছ ধরতে বাধা দেন তাদের ছোট (চার নম্বর) ভাই সোহরাব হোসেন।
হুমকি দিয়ে সোহরাব তখন বলেন, ‘আমার সীমানার সোজা মাছ ধরতে দেব না। মাছ ধরলে মেরে ফেলব।’ খালের পাশেই তাদের বাড়ি। উত্তরে মোশাররফ বলছিলেন, ‘মাছ ধরব। তোর কিছু করার থাকলে করিস।’
এমন উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে সোহরাবের সঙ্গে যোগ দেন আরেক ভাই আশরাফ হোসেন। সঙ্গে তার বউ ও মেয়ে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে গরু জবাই করার ছুরি দিয়ে সোহরাব প্রথমে বড় ভাই আবুল হোসেনের পেটে আঘাত করেন। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
পরে সোহরাব ও আশরাফ মিলে ছুরিকাঘাত করেন সেজো ভাই মোশাররফ হোসেনকে। ছুরি ও শাবল দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকেন। মোশাররফ হোসেন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন নৌখালের কাদার নিচে মোশারফের মাথা চুবিয়ে ধরেন সোহরাব ও আশারফ। এতে ঘটনাস্থলেই মোশারফ মারা যান।
ভয়ঙ্কর এই ঘটনা ঘটে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নৌখালে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শোকের মাতম চলছে ভুক্তভোগীদের বাড়িতে।
এ ঘটনায় বোয়ালিয়াসহ আশপাশের এলাকার মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। গতকাল শনিবার (৫ এপ্রিল) সকালে এ ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আবুল হোসেনের স্ত্রী শিরিনা খাতুন। তিনি পুরো ঘটনার বিস্তারিত এ প্রতিবেদককে শোনান।
আজ রোববার (৬ এপ্রিল) দুপুরে বোয়ালিয়া গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, আবুল হোসেনদের ৬ ভাইয়ের বাড়ি পাশাপাশি। শিরিনা যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন সেখানে আরও ১৫ জনের মতো নারী উপস্থিত ছিলেন। তারাও এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কোনো পুরুষ সদস্যকে দেখা যায়নি।
নিহত মোশাররফ হোসেন শেখপাড়ার মৃত ফজর আলীর ছেলে। ফজর আলীর ছয় ছেলের মধ্যে মেজো ছেলে আলমগীর হোসেন মারা গেছেন ২০০৯ সালে।
শিরিনা খাতুন বলেন, দুই ভাইকে যখন একের পর এক ছুরি মারছে, তখন আমি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বলি, ওদের মেরে ফেলল, তোমরা সবাই এদিকে আসো। সে সময় খালের দুই ধারে কয়েকজন ছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। যখন সব শেষ হয়ে যায়, তখন কেউ কেউ এগিয়ে আসেন।
আবুল হোসেনের স্ত্রী শিরিনা খাতুন বলেন, মোশারফ ও ওর বড় ভাই (আবুল হোসেন) দুজনই কাদায় পড়ে ছিল। মোশারফের মাথা কাদার নিচে পোতা। মোশারফকে ছুরি মেরে তারপর কাদায় পুতে মেরে ফেলে ওরা। আর ওর বড় ভাই তখনও বেঁচেছিলেন। পরে দুজনকেই হাসপাতালে নেওয়া হয়। মোশারফকে মৃত ঘোষণা করে বড় ভাইকে চিকিৎসা দেন ডাক্তার। এখন তিনি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
শিরিনার কথা বলা শেষ হলে পাশে থাকা নারীদের ইশারা করে নিহত মোশররফের স্ত্রী তফুরা খাতুন বিলাপ করছিলেন। বিলাপে তিনি বলছিলেন, আমার পাখিকে (স্বামীকে) তোমরা কেউ বাঁচালে না। আমি আজ ১৭টা বছর সংসার করছি তার সঙ্গে। সবসময় আমি আগলে রেখেছি। একটা দিনের জন্য বাপের (বাবা) বাড়ি গেলাম আর তোমরা আমার পাখি মেরে ফেললে? কেউ আগলে রাখলে না?
তখন জানতে চাইলে তফুরা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি একটা ঝামেলার কারণে বাপের বাড়ি গেছিলাম। বাড়ি ফিরে আমি আর আমার স্বামীকে পেলাম না। আমি ওদের ফাঁসি চাই। আমার পাখির মতো ওদেরও কবরে দেখতে চাই। না হলে আমাকে ও আমার ছেলেকেও মেরে আমার পাখির কবরের পাশে রেখে আসেন আপনারা।
শুধু মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে, নাকি পূর্ব শত্রুতার জেরে এ ঘটনা ঘটেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তফুরা খাতুন বলেন, ২০২৩ সালের আমার শ্বশুরের বাঁশঝাড় থেকে আমার স্বামী বাঁশ কাটে। সে সময় বাঁশ কাটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে। এক পর্যায়ে সোহরাবের বউও এতে জড়িত হয়। পরে বড়ভাই আবুল হোসেন এসে থামানোর চেষ্টা করেন। সে সময় বড় ভাইয়ের সঙ্গেও ঝামেলা করে ওরা। পরে আমার স্বামী ও বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে তারা শ্লীলতাহানির মামলা করে। এ ছাড়া তারপর থেকে নানা সময় কথা কাটাকাটি হয় তাদের।
এদিকে পরিবার সূত্র জানিয়েছে, আজ রোববার সকালে ওই বাড়িতে পুলিশ যায় এবং যে ছুরি ও শাবল দিয়ে দুই ভাইকে কোপানো হয়, তার খোঁজ করে। কিন্তু সারা ঘর তন্নতন্ন করেও এসব খুঁজে পায়নি।
ঘটনার পর অভিযুক্ত দুই ভাই সোহরাব ও আশরাফ, আশারফের স্ত্রী ও তার কন্যাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সামসুল আরেফিন বলেন, আমরা বিস্তারিত তদন্ত করছি। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আসামিদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ঘটনার প্রমাণ পেয়েছি। আরও তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।

 
                   মাসুদ রায়হান পলাশ
                                                  মাসুদ রায়হান পলাশ
               
 
 
 
